Thank you for trying Sticky AMP!!

পেঁয়াজপুরাণ

অলংকরণ : আরাফাত

পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারও। ৪০০ বছরেরও বেশি আগে আ মিডসামার নাইটস নাটকে তিনি ঠিকই পেঁয়াজ না খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। নাটকটির একটি চরিত্র ‘নিক বটম’কে দিয়ে অভিনেতাদের প্রতি তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, ‌‌‘অ্যান্ড মোস্ট ডিয়ার অ্যাক্টরস, ইট নো অনিয়নস নর গার্লিক, ফর উই আর টু আটার সুইট ব্রেথ। অ্যান্ড আই ডু নট ডাউট বাট টু হিয়ার দেম সে, ইট ইজ আ সুইট কমেডি।’ শেক্‌সপিয়ার একটি মিষ্টি হাস্যরসের নাটকের জন্যই অভিনেতাদের কাছ থেকে সুবাসিত নিশ্বাস চেয়েছিলেন। নিশ্বাস সুবাসিত হলেই তো দর্শকেরা মনে করবেন নাটকটা মিষ্টি হাস্যরসে ভরা। শেক্‌সপিয়ারের পেঁয়াজ না খাওয়ার সেই উপদেশ শুনলে আজ আর হয়তো পেঁয়াজের দরদাম নিয়ে নাকাল হতে হতো না।

পেঁয়াজ কাটলে কেন চোখ জ্বালাপোড়া করে—এ নিয়ে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। ছোটবেলায় এ ধাঁধা তো অনেকেই জানেন, ‌‘চক থেকে এল সাহেব কোট–প্যান্ট পরে, কোট–প্যান্ট খোলার পরে চোখ জ্বালা করে।’ এখন তো দেখি এর একটা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও আছে। পার্থক্য হলো এ জন্য পেঁয়াজ কাটতে হয় না, বাজারে দরদাম করলেই হয়। সাকিব আল হাসানের শতক দেখলে যতটা খুশি হই, পেঁয়াজের শতক ততটাই দুঃখ বাড়ায়। এই দুঃখই তো এখন পেতে হচ্ছে, শতক ছাড়িয়েছে পেঁয়াজের দর। এই দুঃখ অবশ্য পাশের দেশের দেওয়া। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এ কথা অবশ্যই বলতে হবে, নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলে এ ধরনের দুঃখ–কষ্ট বারবারই পেতে হবে।

তবে একতরফাভাবে ভারতের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিলে ভুল হবে। সেখানে তো পেঁয়াজ নিয়ে হাহাকার আরও বেশি। বাংলাদেশে চাল যদি হয় এক নম্বর কৌশলগত পণ্য, যার উৎপাদন ও দামের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা, তাহলে ভারতে সেই পণ্য হলো পেঁয়াজ। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দিল্লির মসনদ হারিয়েছিল। ২০১৩ সালেও পেঁয়াজের দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছিল তারা। আর তাই তো গত বছর নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বলছিলেন, কৃষকেরা হবেন তাঁর ‘টপ’ অগ্রাধিকার। এখানে টপ হচ্ছে টমেটো, অনিয়ন বা পেঁয়াজ ও আলু বা পটেটো। তবে রপ্তানি বন্ধ করায় ভারত নিজেও অন্যভাবে বিপদে পড়েছে। এতে তাদের দেশের কৃষকের লোকসান বেড়েছে, ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। সেখানে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, রপ্তানি বন্ধ মোটেই ভালো কোনো পথ না। তাতে ভোক্তারা খুশি হন ঠিকই, কিন্তু উৎপাদকেরা লাভবান হন না। উপায় হচ্ছে দেশের মধ্যেই উৎপাদন বাড়ানো, সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিকঠাক রাখা।

তথ্যসূত্র: এফএও, শত বন্দনা, জিয়াউদ্দিন সাইমুম

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ হয় চীনে। সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস আর শীর্ষ আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। তবে চলতি কথায় সেই যে শোনা যায়, ‌‌‘ছেলে ভালো, কেবল একটু পেঁয়াজ খায়’—এ ব্যাপারে শীর্ষ দেশ কোনটি তা জানা মুশকিল। সব মিলিয়ে বিশ্বে আট কোটি টনেরও বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়।

বিশ্বে যে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, তার ২৫ দশমিক ৬ শতাংশই হয় চীনে, ভারতে প্রায় ২১ শতাংশ। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশেরও কিন্তু একটি অবস্থান আছে। বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হয় বাংলাদেশে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে পেঁয়াজের গড় দর হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৯ সেন্টস, যা বাংলাদেশি টাকায় ৫৮ টাকা। গত বছরের তুলনায় দর বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। তারপরও বলা যায়, পেঁয়াজের বর্তমান উচ্চদর এই অঞ্চলের সমস্যা।

দেশে পেঁয়াজের ঝাঁজের চেয়ে এখন বাজারের ঝাঁজ নিয়েই আলোচনা বেশি। এই সুযোগে অনেকেই পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি খুঁজছেন, রান্নাবান্নায় পারদর্শী ব্যক্তিরা সামাজিক মাধ্যমে পেঁয়াজবিহীন রান্নার রেসিপিও দিতে শুরু করেছেন। প্রাচীন মিসরীয়রা পেঁয়াজের পূজা করত। রক্তের ভারসাম্য বাড়াতে প্রাচীন গ্রিক ক্রীড়াবিদেরা পেঁয়াজ খেত আর রোমান গ্লাডিয়েটররা দেহের মাংসপেশি দৃঢ় করতে পেঁয়াজের রস লাগাত। মহাবীর আলেকজান্ডার সৈন্যদের পেঁয়াজ খেতে বলতেন। সুতরাং, পেঁয়াজ খাব না—এই দল ভারী না করাই ভালো।

তা ছাড়া পেঁয়াজ ছাড়া রান্না কি মুখে রুচবে? পেঁয়াজ কিন্তু সবজি। সবজি খেতে নিরুৎসাহিত স্বাস্থ্যগত কারণে যেমন ঠিক হবে না, উৎপাদকদের কথা চিন্তা করলে অর্থনৈতিকভাবেও তা উচিত নয়। বরং উৎপাদন কী করে বাড়ানো যায়, চাষিরা কীভাবে লাভবান হবেন, সব লাভ মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যাবে না, ভোক্তারাও খুশি থাকবেন—এমন পরিকল্পনা করাই হবে সুস্থ অর্থনৈতিক চিন্তা।