Thank you for trying Sticky AMP!!

বিসমিল্লাহ, বেসিকের কেলেঙ্কারি

আগের বছরটি ছিল হল-মার্ক কেলেঙ্কারির। আর বিদায়ী বছরে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংকের বিরাট জালিয়াতিই ব্যাংক খাতে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়।
এসব বিরাট ঋণ জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার (রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠান) অন্তঃসারশূন্যতাও প্রকাশ পায়।
আর এসব জালিয়াতি আবিষ্কারের পর বাংলাদেশ ব্যাংক তার ‘স্বকীয়তা ও ক্ষমতার দৌড়’ প্রমাণ করতেই যেন হল-মার্কের মতো বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির সব দায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পাঠিয়েই ক্ষান্ত দেয়।
বহু প্রতীক্ষিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন, বছরজুড়ে ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থের পাহাড় জমে থাকা ও বছর শেষে এসে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণ পুনঃ তফসিলে বড় ছাড়ের ঘটনা ছিল গত বছর ব্যাংক খাতের অন্য প্রধান আলোচিত বিষয়।
এর বাইরে বছরজুড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বিনিয়োগ মন্দা থাকায় প্রতিবারই নতুন করে রেকর্ড তৈরি হয়েছে বিজার্ভে। সর্বশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর রিজার্ভ এক হাজার ৮০০ কোটি ডলারের ধাপ অতিক্রম করে।
আবার প্রায় দুই বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ (বায়ার্স ক্রেডিট) আনার যে অনুমোদন দিয়েছিল, ২০১৩ সালের শেষে এসে তার পরিমাণ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।
নানা চড়াই-উতরাইয়ের পরও বরাবরের মতো বিদায়ী বছরও দেশের ব্যাংক খাতের মুনাফা আগের মতোই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হলো, সরকারের ট্রেজারি বিলস্ ও বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ও তার থেকে আয়, বছরের শেষে সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধানে ছাড় এবং ঋণ নবায়ন করে খেলাপি না দেখানো।
বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি: বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতির গোটা তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় বিদায়ী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। জালিয়াতিতে বিসমিল্লাহর যাত্রা শুরু হল-মার্কের আরও আগে। তবে টাকার অঙ্কে হল-মার্ককে ছাড়াতে পারেনি। বিসমিল্লাহ পাঁচ ব্যাংক থেকে সরিয়ে নেয় ১১ কোটি টাকা।
তবে ভুয়া রপ্তানি দেখানো, বিদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার মাধ্যমে অতিমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি এবং এর মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা হাতিয়ে নিতে ‘নতুন উদ্ভাবনী’ তৈরি করে এগিয়ে যায় বিসমিল্লাহ।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী চেয়ারম্যান নওরীন হাসিব দুজনই জালিয়াতি করে দেশ থেকে সটকে পড়েন।
এসব তথ্য উদ্ঘাটন করলেও নতজানু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর গোটা প্রতিবেদনটি দুদকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বছরের শেষভাগে এসে দুদক এক প্রশ্নবোধক চার্জশিট ও এজাহার দায়ের করেছে, যেখানে কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালককেই (এমডি) অভিযুক্ত করা হয়নি। বরং এমনও কর্মকর্তার নাম রয়েছে, যিনি তাঁর ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্যই উদ্ঘাটন করেন।
বেসিক ব্যাংক: রাষ্ট্র খাতের বেসিক ব্যাংক থেকে ভুয়া, বেনামি বা কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিয়ে অর্থ বের করে নেওয়ার খেলা চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এই ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে আরও বছর দুয়েক আগে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেখানে পরিদর্শক পাঠিয়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত উদ্ধার করে আনে। আবার পরিদর্শনকাজ চলাকালেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে পরিদর্শকদেরও ফিরিয়ে আনা হয়। তার পরও উদ্ঘাটিত হয়, ব্যাংকটিতে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সরাসরি এসব জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তার পরও বেসিক ব্যাংককে রাজনৈতিক বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমাহীন ছাড় দেয়। গণমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমঝোতায় বেসিককে স্বাক্ষর করাতে পারে। তবে পর্ষদে নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে মাত্র এক বছর আট মাস মেয়াদের চাকরি করে একজন কর্মকর্তাকে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক করায় ছাড়ের চূড়ান্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অথচ এই কর্মকর্তার পদোন্নতি বিষয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
আইন সংশোধন: ২০০৭ সালের আগে থেকেই ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধনের চেষ্টা ছিল। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দিয়ে কিছু আইনি সংশোধনী হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেগুলো আর সংসদে পাস করেনি। নতুন করে ২০১৩ সালে সেই আইনগুলোকে আরও কিছু সংশোধনী এনে তা সংসদ পাস করে।
সংশোধিত আইনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের চাকরি থেকে অপসারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকে পরিচালকের মেয়াদকাল একনাগাড়ে দুই মেয়াদে সর্বোচ্চ ছয় বছর, পরিচালকের সংখ্যা ২০ জন, পরিচালক নিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়া, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি হলেও রাজনৈতিক বিবেচনা, ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা ও দক্ষতা না থাকলে যত ক্ষমতাই দেওয়া হোক, কোনো কাজে আসবে না। বিদায়ী বছর তারই বহু স্বাক্ষর বহন করে পার হয়েছে।
অবশ্য বিদায়ী বছরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দরিদ্র মানুষ, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধার জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ, কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) ঋণ বিতরণ ও নজরদারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।