Thank you for trying Sticky AMP!!

বড় ও মাঝারি শিল্প কারখানা কমেছে

দেশে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা বন্ধ হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় নামছেন। আবার প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বা অটোমেশনের কারণে শ্রমিক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিল্পকারখানার আকার আরও ছোট হচ্ছে।

গত ছয় বছরে দেশের বড় শিল্পকারখানা বাড়েনি, বরং কমেছে ৬০৮টি। এ সময়ে মাঝারি শিল্পকারখানার সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির হিসাবকে বিতর্কে ফেলেছে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা কমে যাওয়া। আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় ও মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থানও সে রকম হচ্ছে না।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উৎপাদন শিল্প জরিপে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার এই চিত্র উঠে এসেছে। তবে ভালো দিক হচ্ছে, ২০১২ সালের পর থেকে নতুন করে প্রায় আট হাজার ছোট শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন ৪৬ হাজার ২৯১টি কারখানা আছে। ছয় বছরে কারখানার সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪৯৯টি। ২০১২ সালে দেশে ছিল ৪২ হাজার ৭৯২টি কারখানা।

বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার সংখ্যা কমে যাওয়া সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, পাটশিল্প একটি বড় শিল্প ছিল। এই খাতের কারখানা কমেছে। এ ছাড়া অন্য কোনো খাতের কারখানা বন্ধ হয়নি। তৈরি পোশাক, চা–বাগান, সিমেন্টের মতো বড় শিল্প খাতে কারখানা কমেনি। তবে চামড়াশিল্পের কারখানা স্থানান্তরের কারণে এর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার ভিত্তিতে দেশে শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়। এই শিল্পকারখানা স্থাপনের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক আছে, কোনো নিম্নগতি নেই। সরকারের কোনো নীতিগত ভুলের কারণে কোনো শিল্পকারখানা বন্ধ হয়নি। তাঁর মতে, ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি, আসবাব, ডায়মন্ড কাটিংয়ের বিকাশ হবে। এসব খাতে অনেক কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, বড় শিল্পকারখানা হবে।

জরিপে যা আছে

পাঁচ–ছয় বছর পরপর উৎপাদন শিল্প জরিপ করে থাকে বিবিএস। বিবিএসের হিসাবে, কোনো কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা আড়াই শ পেরোলেই বড় শিল্পকারখানা হিসেবে ধরা হয়। গত ছয় বছরে এমন কারখানার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩১টি। আর এক শ থেকে আড়াই শ শ্রমিকের মাঝারি কারখানা ছয় বছরে কমে হয়েছে ৩ হাজার ১৪টি।

২৫ থেকে ৯৯ জন শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানাকে ছোট কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত ছয় বছরে এমন আট হাজার নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে দেশে ২৩ হাজার ৫৫৭টি ছোট কারখানা আছে। সারা দেশে অতিক্ষুদ্র কারখানায় যেখানে ১০ থেকে ২৪ জন কাজ করেন, এমন কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬৮৯টি।

এ কে খান গ্রুপের পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে; কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে। সে কারণে শুধু কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা দিয়ে শিল্প খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। কেননা, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় বড় বিনিয়োগ আসছে।

বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক স্তর নামিয়ে আনার ফলে নব্বইয়ের দশকে অসংখ্য ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০১০—এই দশকেই দেশের শিল্পায়ন বেশি হয়েছে। এ সময়ে প্রায় ১৫ হাজার নতুন শিল্পকারখানা হয়েছে, যা ছিল তখনকার মোট শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১২ সালের পর শিল্পায়নের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত ছয় বছরে মাত্র সাড়ে চার হাজার নতুন কারখানা হয়েছে।

গত দুই দশকে শিল্প খাতের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৯ গুণ। ২০০১-০২ সালের বিবিএসের শিল্প উৎপাদন সমীক্ষা অনুযায়ী, সে সময়ে বছরে ৯০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করত শিল্প খাত। আর এখন শিল্প খাত বার্ষিক ৮ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করছে।

নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, গড়ে ৫৯ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঋণ আছে। প্রতি চারটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি ঋণ নিয়েছে। তবে অতিক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম। গড়ে ৪৪ শতাংশ অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে।

গত এপ্রিল মাসজুড়ে ৯ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালায় বিবিএস। চলতি সপ্তাহে জরিপের প্রাথমিক ফলাফল চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আরও বিস্তারিতভাবে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে।

বিবিএসের শিল্প ও শ্রম শাখার পরিচালক ঘোষ সুবব্রত প্রথম আলোকে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা সংকুচিত করেছে। শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধই হয়ে গেছে। আবার উদ্যোক্তা নিজেই একটি ব্যবসা বন্ধ করে আরেক ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন।

প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বিতর্ক

জরিপ অনুযায়ী, বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানায় গত ছয় বছরে ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯৭১ জনের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে শিল্প উৎপাদন খাতে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ২৯ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ-তরুণী আসছেন। চাকরিপ্রত্যাশী এই বিশাল তরুণ গোষ্ঠীর মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশকে কাজ দিতে পারছে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা শিল্প উৎপাদন খাত। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের হার অনেক কম।

এদিকে, চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে সাময়িক হিসাব দিয়েছে বিবিএস। কিন্তু জিডিপিতে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার হিসাব মিলছে না। একদিকে বিবিএস বলছে, চলতি অর্থবছরে উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ; যা খাতওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি। জিডিপিতে যত মূল্য সংযোজন হয়, এর প্রায় ২৪ শতাংশ আসে শিল্প উৎপাদন খাত থেকে। আর বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার অবদান সাড়ে ২০ শতাংশের বেশি। কয়েক বছর ধরেই জিডিপিতে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানাগুলোর অবদান ক্রমশ বেড়েছে। কিন্তু জরিপ বলছে, গত ছয় বছরে বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার সংখ্যা কমে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিল্পকারখানার হিসাবটি সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা সংখ্যায় কমেছে, কিন্তু উৎপাদন বেড়েছে—এই হিসাব কোনোভাবেই মিলছে না। তিনি এর দুটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, হতে পারে, বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানাগুলো একীভূত হচ্ছে। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিনে নিচ্ছে। অথচ এ ধরনের ঘটনা হলে তো সবাই জানত। যেমন এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক কিনে নেওয়ার সময় সবাই জেনেছে। দ্বিতীয়ত হলো, শিল্পকারখানায় ব্যাপক অটোমেশন হতে পারে। কিন্তু দুটি ব্যাখ্যার একটিও ঘটেনি। জাহিদ হোসেন ইতি টানেন এভাবে, ‘হয় প্রবৃদ্ধির হিসাবটি ভুল, না হয় জরিপটি ভুল।’