ভ্যাট-ভোটের টানাপোড়েনের বাজেট
সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে সামান্যতম ছাড় না দিয়ে বেশি আয় ও বেশি ব্যয়ের নতুন বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আয়করে কোনো ছাড় নেই, ভ্যাটও দিতে হবে ১৫ শতাংশ। এতে চাপ বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়ে। কমবে প্রকৃত আয়।
অর্থমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে যখন বাজেট দিচ্ছিলেন, এই দিনই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের মূল্য। আবার নতুন যে ভ্যাট আইন বাজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেন, তাতে বিদ্যুতের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসার কারণে বাড়বে বিদ্যুতের খরচ। সমালোচনার মুখে বেশ কিছু নিত্যপণ্যকে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্যাট হার সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাজেটের আগে সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছিল ভ্যাট নিয়ে। আবার সামনে আছে ভোটের চিন্তা। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বাজেটে ভ্যাট আর ভোট যেন মিলেমিশে গেল। ভ্যাটও রাখবেন, ভোটের চিন্তাও করবেন—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে অর্থমন্ত্রী ছাড় দিলেন কিছু জায়গায়, আবার রাজস্ব আয়ের চিন্তায় ধরেও রাখলেন কিছু জায়গা। এ কারণেই কমল না করপোরেট কর হার, থাকল ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সীমা।
বাজেট পুরোপুরি ভ্যাটের না, ভোটেরও না।
অর্থমন্ত্রীর একমাত্র লক্ষ্য, যে করেই হোক রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। কারণ, তিনি খরচের খাত উদার হস্তে বাড়িয়ে চলেছেন। মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এগোচ্ছে না মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এবারের বিশাল বাজেট বড় প্রকল্প, বেতন-ভাতা ও সুদ পরিশোধে ব্যয়নির্ভর। আরেকটি অংশ যাচ্ছে রাস্তাঘাট নির্মাণে। নির্বাচনের আগে এমনিতেই রাস্তাঘাট নির্মাণে দলের ভেতর থেকেই চাহিদা বাড়ে। এসব চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনশৃঙ্খলাসহ মানবসম্পদের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমিয়েছেন তিনি।
এসব নিয়েই অর্থমন্ত্রী যেতে চেয়েছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। এ জন্য অর্থমন্ত্রী ভরসা রাখছেন ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধিকে। কিন্তু মহাসড়কের বাধাগুলো নিয়ে কথা বলেননি তেমন। অর্থমন্ত্রী এমন এক সময় উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে চাইছেন, যখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। কমে গেছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির গতি। বড় ধরনের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে। আবার দেশের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বছর ধরেই স্থবির। সরকারি হিসাবেই কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। বাড়ছে অর্থ পাচার। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা প্রকট। কিন্তু এসব কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই বাজেটে। তারপরও অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটের নাম দিয়েছেন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’।
কয়েকটি অনুমানের ভিত্তিতে নতুন বাজেটের মাধ্যমে নতুন অর্থবছরে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠবেন অর্থমন্ত্রী। যেমন নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি থাকবে সাড়ে ৫ শতাংশ, সুদের হার আরও কমবে, উদ্বৃত্ত থাকবে সার্বিক লেনদেনের হিসাবে, মুদ্রানীতি থাকবে সহায়ক, কর আদায় বাড়বে, বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার বাড়বে, বাড়বে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় এবং বিঘ্ন হবে না রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। প্রত্যাশার কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাশা আশাবাদ জানানো ছাড়া তেমন কিছুই নেই নতুন বাজেটে। সংস্কার তো বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। ফলে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত বাজেটের পুরো বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। যেমনটি হয়নি চলতি অর্থবছরের বাজেটের বাস্তবায়নে।
গতকাল দুপুরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বাজেট প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। অর্থমন্ত্রী সরকারের এ মেয়াদের চতুর্থ এই বাজেট উপস্থাপনা শুরু করেন গত সাত বছরের অর্থনৈতিক সাফল্যের মাল্টিমিডিয়া প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। টানা ৯ বার বাজেট উপস্থাপন অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি নতুন রেকর্ড। তবে সব মিলিয়ে তিনি বাজেট দিলেন ১১ বার। বেশি বাজেট দেওয়ার রেকর্ডটি অবশ্য বিএনপি সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের—১২ বার।
বাজেট পরিসংখ্যান: আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মূল বাজেট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। বড় বাজেট দেওয়া হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে না—এই রীতি থেকে এবারও বাজেটকে বের করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।
আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর, এনবিআর-বহির্ভূত কর, কর ব্যতীত প্রাপ্তি ও সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব প্রাপ্তি ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে স্বীকারোক্তি দেন, ‘আয়কর, মুনাফা কর ও ভ্যাটে আদায় আশানুরূপ হয়নি।’
রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) থেকে সংগ্রহের লক্ষ্য সর্বোচ্চ ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট থেকে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা আদায় করতে না পেরে সংশোধিত বাজেটে করা হয় ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরোক্ষ করই হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা।
আগামী অর্থবছরের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ ব্যয় ২ লাখ ১৫ কোটি ৭৪৪ কোটি টাকা ধরেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় করার পরিকল্পনা ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) আগামী অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা, যা পরে করা হয় ৯৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
অর্থ সংস্থানের মধ্যে আগামী অর্থবছরে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ৪৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ লক্ষ্য ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা ধরা হলেও ঋণ না পাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ধরা হয় ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে আগামীবারের বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক ঋণের এত প্রাক্কলন আর কখনো হয়নি। অর্থনীতিবিদেরা একে অবাস্তব বলেই সমালোচনা করছেন। এ ছাড়া বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি ধরা হলেও সরকার এ সীমার মধ্যে থাকতে পারেনি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তাই অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্য করা হয় ৬৯ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
ব্যাংকঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় উৎস হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সরকার বিক্রি করে ৪৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। আগামীবারের লক্ষ্য ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এবারের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থায়নের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তে পারে।
উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যেতে যে সুশাসন প্রয়োজন, সে কথা অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষে নিজেই বলেছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্যও তিনি দিয়েছেন। বলেছেন প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা। বলেছেন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও ব্যক্তি খাতের বিকাশের কথা। কিন্তু কাজটি কীভাবে হবে তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই এবারের বাজেটে। তারপরও অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা, ‘সমৃদ্ধির মহাসড়কে নিরন্তর অভিযাত্রা চলবেই এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকবে।’ নতুন বাজেট শেষ পর্যন্ত কত দূর নিয়ে যেতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।