Thank you for trying Sticky AMP!!

লিচুর রাজ্যে 'মধু' বিপ্লব

দিনাজপুর সদর, বিরল, চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলায় লিচুবাগানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মৌমাছির চাষ। ছবি: প্রথম আলো
>
  • লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের নীরব বিপ্লব দিনাজপুরে।
  • গত বছর লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ ২৩ হাজার ৩৬০ কেজি।
  • মৌচাষিদের হিসাবে তা প্রায় দ্বিগুণ।
  • মৌমাছি লিচুর ফুলে পরাগায়ন ঘটানোয় ফলন ভালো হয়।

সুস্বাদু লিচুর জন্য বিখ্যাত উত্তরের জেলা দিনাজপুর। ভরা মৌসুমে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু লিচু আর লিচু। পাকা লিচুর লাল রঙে পুরো জেলায় এক অপরূপ দৃশ্য ধরা দেয়। মনে হয় যেন লিচুর রাজ্য।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় বলছে, এই লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের নীরব বিপ্লব ঘটেছে দিনাজপুরে। সরকারি হিসাবে গত বছর দিনাজপুরে লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ২৩ হাজার ৩৬০ কেজি। যদিও মৌচাষিদের হিসাবে তা প্রায় দ্বিগুণ। মৌমাছি লিচুর ফুলে পরাগায়ন ঘটানোয় ফলন ভালো হয়। এতে দিন দিন লিচুর উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বিপুল পরিমাণ মধুও সংগ্রহ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর ধরে এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে লিচুর মধু সংগ্রহ চলছে। আর ২০১৫ সাল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে।
গত সপ্তাহে সরেজমিনে দিনাজপুর সদর, বিরল, চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক লিচুবাগানে রাখা হয়েছে মৌ-বাক্স। তার পাশে গাড়া তাঁবু। সেসব তাঁবুতে বসত গেড়েছেন মৌচাষিরা। তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে। কেউ কেউ বগুড়া, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার।
মৌচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার লিচুর ফুল ভালো হওয়ায় গত বছরের চেয়ে বেশি মৌচাষি দিনাজপুরে এসেছেন। সবচেয়ে বেশি চাষি এসেছেন বিরলে। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২০০ মৌচাষি এসেছেন দিনাজপুরে। প্রত্যেকে কমপক্ষে ১০০টি মৌ-বাক্স নিয়ে এসেছেন। ১০০ মৌ-বাক্স আছে এমন একজন চাষি কমপক্ষে ১ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করবেন।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৫ হাজার ২৮১ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান হয়েছে। এর মধ্যে বিরলে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান হয়েছে। গত বছর মধু সংগ্রহের জন্য ৪ হাজার ৯৫৪টি বাক্স স্থাপন করা হয়েছিল।

যেভাবে শুরু
উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ সাজেরুল ইসলামের কাছ থেকে জানা গেল, দিনাজপুরে লিচুবাগানে প্রথম মধু সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে আসেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আবদুর রশীদ। তিনি মৌচাষি সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আবদুর রশীদ জানান, ২০০৩ সালে বীরগঞ্জ উপজেলায় ব্র্যাকের উদ্যোগে কিছু চাষিকে মৌমাছি দিয়ে মুলা, পেঁয়াজ ও মিষ্টিকুমড়ার ফুলে পরাগায়নের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু হয়। সে সময় তিনি বীরগঞ্জের চাষিদের জন্য মৌমাছির বাক্স ভাড়া নিয়ে আসতেন। মুলা, পেঁয়াজ, আর মিষ্টিকুমড়ার পরাগায়ন শেষ হওয়ার পর রানি মৌমাছির খাবার নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান তিনি। তিনি জানতেনও না কোন কোন ফসলে মধু পাওয়া যায়। এ সময় বিসিকে কর্মরত এক ব্যক্তি আবদুর রশীদকে জানান যে লিচুর ফুলে মধু পাওয়া যায়।
এরপর বিরলে গিয়ে একটি বাগানে তাঁবু গাড়েন। কিন্তু লিচুর ফুল মৌমাছি খেয়ে ফেলবে—এ জন্য অনেকেই বাগানে মৌ-বাক্স স্থাপন করতে দিতে রাজি হননি। এ সময় এগিয়ে আসেন মাধববাটি এলাকার এক ব্যক্তি। মৌমাছি পরাগায়ন ঘটানোয় লিচুর উৎপাদন বেশি হওয়ার বিষয়টি জানালে তিনি আবদুর রশীদকে তাঁর বাগানে মৌ-বাক্স স্থাপন করতে দেন। এরপর ধীরে ধীরে অন্য বাগানমালিকেরা বিষয়টি জানার পর চাষিদের দিনাজপুরে আসা শুরু হয়।
বিরলের মহেশপুর এলাকার বাগানমালিক আফছার আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিরলে তাঁর সাতটি লিচুবাগান রয়েছে। লিচুর ফুলের পরাগায়ন না হলে ফলন কম হয়। লিচুগাছে ফুল এলে তিনি নিজেই মৌচাষিদের ডেকে আনেন। একই কথা জানান মাধববাটি এলাকার বাগানমালিক আবদুল হাই।

যেভাবে সংগ্রহ হয় মধু
বিরলের মাধববাটি গ্রামের আরিফুল ইসলামের বাগানে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ইউনুস আলী শেখ, উল্লাপাড়া মারুফ হোসেন এবং কামারখন্দের সাজিরুল ইসলাম। ইউনুস আলী জানান, মধু সংগ্রহের জন্য তাঁরা ১৫ থেকে ২০ দিন একটি বাগানে থাকেন। প্রতিটি গাছের নিচে ১২-১৫টি মৌমাছির বাক্স রাখেন। এক চেম্বারের প্রতিটি বাক্সে ১০টি এবং দুই চেম্বারের একটি বাক্সে ২০টি ফ্রেম থাকে। ১০ ফ্রেমের একটি বাক্সে ২০ হাজার পর্যন্ত মৌমাছি থাকে। চার থেকে সাত দিন পর বাক্সগুলো থেকে ফ্রেমে থাকা মৌমাছিগুলো সরিয়ে মধু সংগ্রহ করা হয়।
মাধববাটির আবদুল হাইয়ের বাগানে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে মধু সংগ্রহে আসা রাজু আহমেদ জানান, এক চেম্বারের বাক্স থেকে পাঁচ থেকে সাত দিন পর ৩ থেকে ৫ কেজি এবং দুই চেম্বারের বাক্স থেকে ৭ থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মধুর পাইকারি মূল্য ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা।
উল্লাপাড়ার মৌচাষি ইব্রাহীম আলী জানান, আগে এসব মধু ভারতে যেত। এখন প্রাণ, প্রশিকাসহ বিভিন্ন কোম্পানি এসব মধু কিনে নেয়। কিছু মধু স্থানীয় দোকানিরা কিনে খুচরা বিক্রি করেন।

যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, লিচু
একটি পরাগায়িত ফল। মৌমাছি দিয়ে পরাগায়ন
হলে লিচুগাছে ২০ ভাগ বেশি উৎপাদন হয়। বর্তমানে লিচুর ফুল থেকে সবচেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ হচ্ছে। পুষ্টিগুণও অনেক ভালো। লিচুর ফুলের মধু জমাট বাঁধে না। তবে লিচুর পরাগায়ন নিয়ে এখনো দেশে গবেষণা হয়নি।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বলেন, তিনি সম্প্রতি দিনাজপুরে যোগদান করে দেখেতে পেয়েছেন, মধু সংগ্রহে বিপ্লব ঘটেছে। স্থানীয় লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি বিপুল আয়ও হবে।