Thank you for trying Sticky AMP!!

সূচক ৭ হাজার ছাড়াল প্রথমবারের মতো

অর্থনীতির অন্য প্রায় সব সূচক নেতিবাচক থাকলেও শেয়ারবাজারে চলছে তেজিভাব। বাজার বিশেষজ্ঞরা অবশ্য একে অস্বাভাবিক বলছেন না।

শেয়ারবাজার

করোনার কারণে ব্যবসা নেই, তবু এক বছরে একটি বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে ৯ গুণ। প্রণোদনার টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা শেয়ারবাজারে খাটাচ্ছেন বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের। আবার ব্যাংকগুলো তাদের মূল ব্যবসা ‘ঋণ দেওয়া’কে পাশ কাটিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করায় মনোযোগ বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল রোববারই আইন লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করায় একটি ব্যাংককে জরিমানা করেছে। এর আগে বিশেষ তহবিলের অপব্যবহার করায় ১২টি ব্যাংককে সতর্কও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এত সব ঘটনার মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এই শেয়ারবাজার কি স্বাভাবিক শেয়ারবাজার না অস্বাভাবিক? সেই আলোচনার সুরাহা না হলেও এরই মধ্যে গতকাল একটি রেকর্ড হয়ে গেছে শেয়ারবাজারে, যা দেশের ইতিহাসে অনন্য ঘটনা। ঘটনাটি হচ্ছে প্রথমবারের মতো ৭ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক ছাড়িয়ে গেছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স।

ডিএসইর এই ডিএসইএক্স সূচকটি চালু হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। এরপর গতকালই প্রথম তা ৭ হাজার পয়েন্টের ঘর ছাড়িয়ে গেল। একই তালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান মূল্যসূচক সিএএসপিআই গতকাল ১২ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন বন্ধ থাকার পর নতুন সপ্তাহের প্রথম দিন ছিল গতকাল। সকাল ১০টায় লেনদেন শুরু হলে প্রথম দফাতেই সূচক পৌঁছে যায় ৭ হাজার পয়েন্টের ঘরে। দিন শেষে তা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৭ পয়েন্টে, যা আগের দিনের চেয়ে ৭৬ পয়েন্ট বেশি।

সুসংবাদ বনাম শঙ্কা

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত–উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয় বলে বাজার বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তবে এই সময়ে এমন সব কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে, যেগুলোর মৌলভিত্তি দুর্বল এবং মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) অনেক বেশি।

বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, যার পেছনে ব্রোকার হাউস ও কোম্পানির উদ্যোক্তারাই জড়িত। কিছু কৌশল অবলম্বন করে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। আর একই কৌশলের অংশ হিসেবে ব্রোকার হাউসগুলো বেশি দাম দিয়ে শেয়ার কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এতে অহেতুক দাম বাড়ছে শেয়ারের।

ডিএসইএক্সের মূল্যসূচক যখন ৭ হাজার পয়েন্ট ছুঁই ছুঁই করছিল, তার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বেশি মাত্রার বিনিয়োগের বিষয়টি টের পায়। গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সব তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

বিএসইসি সূত্র জানায়, বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি তারা। পরদিনই সংস্থাটি তার কৌশল ঠিক করে নতুন বার্তা দেয় বিনিয়োগকারীদের। নতুন এক আদেশ জারি করে বিএসইসি ওই দিন জানায়, ডিএসইএক্স ৮ হাজার পয়েন্টে না যাওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ১০০ টাকার বিনিয়োগের বিপরীতে ৮০ টাকার ঋণসুবিধা বহাল থাকবে। অথচ বিএসইসিরই আগের নির্দেশনা ছিল, ডিএসইএক্স ৭ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গেলেই ঋণ মিলবে ১০০ টাকার বিপরীতে ৫০ টাকা।

এটা কোনো স্বাভাবিক শেয়ারবাজার কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে এ বাজারের পিই অনুপাত ছিল ৩২, এখন ১৭। সে বিবেচনায় বর্তমান বাজারকে অতিমূল্যায়িত বলার সুযোগ কম। তা ছাড়া ভালো মৌলভিত্তির অনেক শেয়ারের দাম এখনো ততটা বাড়েনি। তবে এটা ঠিক বাজারে তেজিভাব থাকলে দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারের দামও বাড়ে। কিছু কোম্পানির ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে।

বৃদ্ধির কারণ হিসেবে যা বলা হচ্ছে

করোনার কারণে গত বছর বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম যখন বেশি মাত্রায় কমে যাচ্ছিল, তখন বিএসইসি দাম কমার ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েছিল। একটি সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছিল, এর চেয়ে বেশি হারে শেয়ারের দাম কমতে পারবে না। তবে বাড়তে পারবে বেশি হারে।

ঢাকার শীর্ষ পাঁচ ব্রোকার হাউসের অন্তত তিনটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল কথা বলে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তো বটেই, হাতে ভালো তারল্য থাকায় অনেক ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। স্বাভাবিক কারণেই শেয়ারের দাম ও সূচক বাড়ছে।

এ কথার সত্যতা মিলিয়ে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রবাহ কমেছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকঘোষিত সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থেকে গেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রায় একই প্রবণতা চলছে চলতি অর্থবছরেও। অন্যদিকে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার এখন ৩ থেকে ৪ শতাংশ। এমনকি স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) সুদের হারও ৫ থেকে ৭ শতাংশের মতো। এ ছাড়া আছে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. ছাইদুর রহমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি। এর কারণ হচ্ছে এখনো অনেক খাতের পিই অনুপাত ১০–এর নিচে। এগুলো বাড়লে মূল্যসূচক আরও বাড়বে। কোম্পানির তথ্য ও লভ্যাংশ দেওয়ার রেকর্ড দেখে বিনিয়োগ করতে হবে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, না বুঝে এবং গুজবে কান দিয়ে কেউ যেন বিনিয়োগ না করেন। বিনিয়োগ করতে হবে এই ভেবে যে ব্যাংকে এফডিআর করলে তিনি যা পেতেন তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ পাবেন কি না, সেটা বিবেচনায় রেখে। আর ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কখনোই উচিত নয়।’

চিন্তার বিষয় দুর্বল কোম্পানি

এক বছর আগে প্রভাতী ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বাজারমূল্য ছিল ৩০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গতকাল তা ১৭৯ টাকায় বিক্রি হয়। গত মার্চেও এর শেয়ারের দাম ছিল ৭০ টাকার ঘরে। মাঝখানে গত জুলাই মাসে ২০০ টাকার ঘরেও লেনদেন হয় এই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার। গত এপ্রিলে ডিএসই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দিলে কোম্পানিটি জানায়, ‘মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানা নেই’। একইভাবে ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্সের শেয়ারের দামও বাড়ে ৭ গুণ। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই কাজে কারসাজির সুযোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে ২০১৫ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি মন্দমানের অর্থাৎ ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ার ঢাকা ডায়িং। এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ে ৫ গুণ। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, এ রকম অন্তত ৭০টি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বাজারে ২১টি খাত রয়েছে। করোনা চলাকালে ওষুধ খাত ভালো ব্যবসা করলেও অন্য খাতগুলো তেমন একটা পারেনি। কিন্তু দাম বেড়েছে সবারই। এমনকি ব্যাংকঋণ নিয়েও অনেকে টাকা খাটাচ্ছেন শেয়ারবাজারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯–এর প্রভাবে অর্থনীতির প্রকৃত খাত ভালো যায়নি। শুরুর দিকে শেয়ারবাজারও এতটাই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল ছিল যে ফ্লোর প্রাইস পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। ফলে যতটা নেমে গিয়েছিল, সে তুলনায় এই বৃদ্ধিটা যৌক্তিক বলেই মনে হয়।’

মোহাম্মদ হেলাল আরও বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় বিএসইসির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মূল্য সংবেদনশীল বক্তব্য দিচ্ছেন। অথচ শেয়ারবাজার নিয়ে বিএসইসির মতো সংস্থাগুলোর বিশ্বচর্চা এমন নয়। বাজারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়তে পারে, এমন কোনো বক্তব্য অন্তত বিএসইসির দিক থেকে না আসাটাই ভালো।’