Thank you for trying Sticky AMP!!

'জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়'

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে ৩০ দশকের পরে সবচেয়ে বড় মন্দার মুখোমুখি এখন পুরো বিশ্ব। তবে এবারের মন্দাকে এখনই আরেকটি মহামন্দা বলার সময় এখনো আসেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সবাই আরেকটি মহামারি দেখছি, আরেকটি মন্দার মধ্যে ঢুকেও গেছি।

১৯২৯ সালে শুরু হওয়া সেই মহামন্দার উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে, শেয়ারবাজারের পতনের হাত ধরে। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন হারবার্ট ক্লার্ক হুভার। দেশটির ৩১তম প্রেসিডেন্ট হুভার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯২৯ সালের ৪ মার্চ, আর শেয়ারবাজারের পতন ঘটে ২৪ অক্টোবর। ওই দিনটিকে আজও ‘কালো মঙ্গলবার’ বলা হয়। হুভার দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিগত আট বছরের নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে শিগগিরই তিনি ঈশ্বরের কৃপায় দেশ থেকে দারিদ্র্য বিলুপ্ত করতে পারবেন। প্রতিশ্রুতি দিলেও সে কাজটি আর হয়নি, বরং দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে গিয়েছিল। হারবার্ট হুভার আজও একজন ব্যর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবেই পরিচিত হয়ে আছেন।

হারবার্ট হুভার শুরুতেই বলেছিলেন, মন্দা খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না। তিনি অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও খুব একটা শোনেননি। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ওপরও তিনি তেমন ভরসা করেননি। মন্দার প্রসঙ্গ এলেই এখনো হুভার আলোচনায় আসেন তাঁর দেওয়া বাজেটের জন্য। সে সময় ভারসাম্যপূর্ণ বাজেটেই নির্ভরতা বা বিশ্বাস ছিল বেশি। ঘাটতি বাজেট পছন্দের ছিল না। কিন্তু মহামন্দায় সরকারের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছিল, আর আয় কমছিল। বাজেট ঘাটতি মেটাতে করের হার বাড়িয়ে দেন তিনি। এসব পদক্ষেপ জনপ্রিয় হয়নি, বরং মন্দা আরও দীর্ঘ হয়। হুভার ছিলেন রিপাবলিকান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেও তিনি ছিলেন প্রবল ক্ষমতাধর। কিন্তু এক মেয়াদের বেশি টিকতে পারেননি। ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে হেরে যান। প্রায় ১০ বছর স্থায়ী সেই মহামন্দার অবসান ঘটে রুজভেল্টের হাত ধরে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এর রেশ বজায় ছিল।

মন্দা দেখা দিলে সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি। এটা অবশ্য হুভারের সময় ততটা জানা ছিল না। যদিও রুজভেল্ট তা বিশ্বাস করতেন। আর এই ধারণার বড় প্রবক্তা হলেন লর্ড মেনার্ড কেইনস। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্দা থেকে উত্তরণে সরকারি ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর বিনিয়োগ বাড়ানো হলে ভোগ উৎসাহিত হবে, তাতে উৎপাদনও বাড়ে। এতে জাতীয় আয় বাড়ে। ফলে সঞ্চয়ও বাড়বে, আর এর মানেই হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

>নতুন অর্থবছরটি অন্য সব অর্থবছরের মতো স্বাভাবিক হবে না। এ সময়ে থাকবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কঠিন এক চ্যালেঞ্জ।

৩০ দশকের পরেও মন্দা দেখেছে বিশ্ব। এর মধ্যে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া মন্দার রেশ ছিল দীর্ঘদিন। সেই মন্দার আঁচ অবশ্য লাগেনি বাংলাদেশে। কিন্তু কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আক্রান্ত। অর্থনীতি স্থবির। রপ্তানি কমেছে, আমদানিও কম, একসময়ের ভালো সূচক প্রবাসী-আয় নিয়ে আছে দুশ্চিন্তা। সবচেয়ে দুরবস্থা বেসরকারি বিনিয়োগের। মানুষের আয় কমে গেছে, বাড়ছে বেকারত্ব। খরচ কমাচ্ছে বেসরকারি খাত। এতে কমছে সামগ্রিক চাহিদা। আর এ রকম একসময়েই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন বাজেট পেশ করলেন, পাসও করালেন। আজ থেকেই শুরু হচ্ছে নতুন আরেকটি অর্থবছর, ২০২০-২১।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতিতে কোভিড-১৯–এর নানা প্রভাব, সংকট ও ঝুঁকির কথা বেশ ভালোভাবেই উল্লেখ করেছেন। তবে বাজেট কাঠামোর পর্যালোচনা করলে অবশ্য মনে হবে কোথাও তেমন কোনো সংকট নেই। ১৯২০-২১ সালেও বিশ্বে একবার মন্দা এসেছিল। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভার সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই ভেবেছিলেন ৩০–এর মন্দার ভাগ্যেও তা–ই ঘটবে। আমাদের বাজেটকাঠামো দেখেও অনেকের মনে হতে পারে, শিগগিরই মিলিয়ে যাবে করোনাভাইরাস। বিশেষ করে রাজস্ব আয় ও প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তাতে মনে হবে ১ জুলাই থেকে সব আবার চলবে আগের মতো, অর্থনীতি পুরোমাত্রায় থাকবে সচল, উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটবে না, ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন, বাড়বে কর্মসংস্থান, তাতে মানুষের আয় বাড়বে এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়ে যাবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

অথচ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন যে বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯-এর প্রভাবে রাজস্ব আয় ও ব্যয় উভয়ই প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কম হবে। তারপরও সংশোধিত বাজেটে তিনি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছিলেন মাত্র ২৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। আর এর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করেছেন নতুন বাজেট। 

সাধারণত অর্থবছর শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে থেকেই নতুন বাজেটের কার্যক্রম শুরু হয়। আর মার্চ বা ৯ মাসের অর্থনৈতিক সূচকের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলন করা হয়। সম্ভবত এবারও সেই প্রথা থেকে বের হতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বিভাগ। বাজেটের অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রায় সব ধরনের পরিসংখ্যান সেই মার্চের সূচক ধরেই হয়তো প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী যখন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন, তখন বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত, অর্থনীতি পর্যুদস্ত। তত দিনে বদলে গেছে অনেক হিসেব-নিকেশ। কিন্তু ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসেব আর বদলায়নি। এতে বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতাই অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে।

এক অর্থে আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য বিষয়টি দুর্ভাগ্যেরই বলা যায়। এক মহা অস্বাভাবিক সময়ে বাজেট দিতে হয়েছে। ঠিকঠাক পরিকল্পনাও করতে পারেননি। এখনো কেউ জানেন না কবে শেষ হবে এই মহামারি, কবে স্বাভাবিক হবে অর্থনীতি। মন্দা কত দিন দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা–ও পরিষ্কার নয়। সব মিলিয়ে মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতি। অথচ এর মধ্যেও জিডিপির আসক্তি থেকে বের হতে পারলেন না অর্থমন্ত্রী। আজ থেকে যে নতুন অর্থবছর শুরু, সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার ঠিকঠাক বাস্তবায়ন। তা হলে বাজেটেরও বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। সুতরাং জিডিপি কত শতাংশ হবে, সে ভাবনা মাথা থেকে বের করে দেওয়াটা হবে বড় কাজ।

বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনার একটি দলিল। আর এই মহামারির সময়ে সরকারি ব্যয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে আয়ের দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। বাজেট ঘাটতি এবার বাড়বে সবাই ধরেই নিয়েছেন। তবে ঘাটতি অর্থায়নের উৎসটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক উৎস থেকে যত বেশি নেওয়া যায়, ততই ভালো। আর সবকিছুর মূল লক্ষ্য থাকতে হবে চাহিদা বৃদ্ধি। মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষদের টিকিয়ে রাখতে হবে, কর্মক্ষমদের দিতে হবে কাজ। আর এ জন্য দরকার বিনিয়োগ।

আবারও ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে ফিরে যাই। ৩০ দশকের মহামন্দা টিকে ছিল প্রায় ১০ বছর। নির্বাচিত হয়েই তিনি সরকারি পরিকল্পনার মাধ্যমে মন্দা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিনের মধ্যেই তিনি যে পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার নাম ‘নিউ ডিল’। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান তৈরি করা। সে সময় তিনি কর্মসংস্থানহীনদের জন্য যে কর্মসূচি বা স্কিম প্রণয়ন করেছিলেন, তার অনেক কিছু এখনো বহাল আছে। নিউ ডিলের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা, শেয়ারবাজারের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা, আমানত বিমা স্কিম-এসবও ছিল। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতই দেশের সবচেয়ে বড় খাত। অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখছে অসংখ্য ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয় এখান থেকে। কিন্তু তাদের বড় অংশই ব্যাংকের বাইরে। তারা কোনো ব্যাংকঋণ পায় না। সরকার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে, তা মূলত ব্যাংকনির্ভর। সুতরাং বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখা, সহায়তা দেওয়া।

সব মিলিয়ে বিশাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে অর্থনীতি, সরকার এবং অর্থমন্ত্রী। একটি গতানুগতিক বাজেট বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে না। চাই নতুন কিছু। সেই প্রত্যাশাই থাকুক আজ থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য।

অর্থবিলের পাসের সময় অর্থমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথের জীবনসায়াহ্নে রচিত শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ‘রূপ–নারানের কূলে’ কবিতার বিখ্যাত কয়েকটি লাইন নিজের মতো করে বলেছিলেন। সেটি হচ্ছে, ‘সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম—/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আর অর্থমন্ত্রী সেটিই বলেছিলেন এভাবে, ‘সত্য যে বড় কঠিন,/ তাই সব জেনেশুনে আমরা এই কঠিনকেই ভালোবেসেছি।’ 

সেই একই কবিতার শুরুটা বরং আমি এখানে বলতে চাই। কারণ বাস্তবতা এটাই। ‘রূপ–নারানের কূলে/ জেগে উঠিলাম,/ জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।’