Thank you for trying Sticky AMP!!

'সদাগর ভাই' আর 'সেলাই আপু'

রুবাবা আকতার ও আরিফ মোহাম্মদ আবদুস শাকুর চৌধুরী

প্রেমের জন্য মানুষ যুগে যুগে কত কী করেছে। প্রেমের নিদর্শন তাজমহল তারই সাক্ষ্য দেয়। প্রেমে পড়ে কতজন কত ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। আরিফ মোহাম্মদ আবদুস শাকুর চৌধুরী আর রুবাবা আকতারকেও তাঁদের দলেই ফেলা যায়। প্রেমে পড়ে অল্প বয়সে পরিবারের অমতেই ঘর বেঁধেছিলেন তাঁরা। এক কামরার ছোট্ট ঘরের মেঝেতে শুয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘কিছু একটা হয়ে ওঠার’। এখন তাঁদের যা যা আছে—‘সেলাই’ নামে তাঁদের পোশাকের পাঁচটি আউটলেট। ‘সদাগর ডটকম’ নামের পাইকারি পণ্য বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। নিজস্ব ব্র্যান্ডের জুতার দোকান। শিশুদের স্কুল। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ৭২ জন কর্মী রয়েছেন। পোশাকের আউটলেটের কর্মীদের প্রায় সবাই নারী।

তবে এই সফলতার পথে এই দম্পতিকে প্রবেশ করতে বহু ঝড়ঝঞ্ঝা পেরোতে হয়েছে। শুরুর সেই কথাই তাঁরা বললেন প্রথম আলোকে। ১৬ বছরের দিনরাত পরিশ্রমের ফলে এখন স্বামী-স্ত্রী দুজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। দুজন তাঁদের কাজের দায়িত্বও ভাগ করে নিয়েছেন।

সফটওয়্যার প্রকৌশলী আরিফ মোহাম্মদ আবদুস শাকুর চৌধুরী এখন ব্যবসায়ীদের জন্য পাইকারি পণ্যের অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘সদাগর ডটকম’–এর প্রধান নির্বাহী। আর রুবাবা আকতার ‘সেলাই’–এর প্রধান নির্বাহী। এর মধ্যে ‘সদাগর ডটকম’ প্ল্যাটফর্মটিতে ১ হাজার ৪০০ দেশি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ী তাঁদের পণ্য পাইকারি বিক্রি করছেন। আর ঢাকাতেই রুবাবার ‘সেলাই’–এর পাঁচটি আউটলেট রয়েছে।

বনানীতে সেলাইয়ের একটি আউটলেটে বসে সেই ছোট্ট দরজির দোকান দিয়ে যাত্রা শুরু কথা বলতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আরিফ বললেন, ‘ছোট চাকরির বেতনের টাকা থেকে জমানো অর্থ বিনিয়োগ করি ওই দরজি দোকানের জন্য। কেউ চিনতেন না। ছয় মাস পর্যন্ত কোনো অর্ডার সেভাবে পাইনি। প্রায় ফাঁকা দোকানে একগাদা দুশ্চিন্তা নিয়ে দুজনের দিন কাটত। আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে এখন আমরা ভালো আছি।’

আরিফের বাড়ি বগুড়া। আর রুবাবার বাড়ি মাদারীপুর। আরিফ জানালেন, বিয়ের আট বছর পর দুই পরিবার তাঁদের বিয়ে মেনে নেয়। দুজনই তখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে। কষ্টের সময়টায় দুজন মিলে পাড়ি দিয়েছেন। এর মধ্যেই রুবাবা ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর পড়াশোনা শেষ করেছেন। আরিফ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি নিজের সফটওয়্যার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন।

রুবাবা বলেন, ‘দুজনকে উঠে আসতে যে সংগ্রাম আর চ্যালেঞ্জ পার হয়ে আসতে হয়েছে, তা বলার মতো নয়। আরিফকে রাত-দিন মাথায় করে কাপড় টানতে হয়েছে। সংসার চালাতে পড়তে পড়তেই চাকরি করতে হয়েছে। তবে আশা ছাড়িনি।’

রুবাবার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরিফ বললেন, ‘রাত জেগে পোশাকের বস্তা টেনেছি, পোশাকের থান কেটেছি। পরিশ্রম বৃথা যায়নি।’

এই দম্পতি জানালেন, সেলাই এখন হয়ে উঠেছে বড় একটি নাম। এখন দেশ-বিদেশ থেকে নানা ক্রেতা সেলাইয়ের পোশাক কিনছেন। তাঁরা নিজস্ব জুতার দোকান খুলেছেন। সেলাই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করেন। ইতিমধ্যে ৪৬ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করেছেন তাঁরা। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে পাঁচজন ছাড়া সবাই নারী কর্মী।

আরিফ কলসেন্টার ম্যানেজমেন্ট, ইআরপিসহ বিভিন্ন সফটওয়্যার উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবেও চাকরি করেছেন। তবে স্বাধীন উদ্যোক্তা হিসেবে ই-কমার্স খাতে ব্যবসা থেকে ব্যবসার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বুঝতে পারেন। এরপরই তিনি গবেষণা ও পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। দেশের অধিকাংশ জেলায় তিনি ভ্রমণ করেন এবং পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে এক জেলার অপ্রচলিত পণ্য অন্য জেলায় বিক্রির সুযোগ তৈরি করেন তিনি। ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তাঁর এ উদ্যোগটি। ব্যবসায়ী ও আগ্রহী তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘সদাগর ভাই’ হিসেবে। তাঁকে এ উদ্যোগে সহযোগিতা করছেন সহ-উদ্যোক্তা জাহিদুল আলম শাহ।

অপর দিকে এত দিন সেলাইয়ের ক্রেতারা শুধু অফলাইনে এর নাম জানতেন। কিন্তু ফেসবুক লাইভের যুগে এসে রুবাবা বুঝতে পারেন মানুষ এখন অনলাইনকেন্দ্রিক হচ্ছে। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে তিনিও ফেসবুক লাইভে এসে পোশাক বিক্রি শুরু করেন। পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘সেলাই আপু’ হিসেবে।

রুবাবা বললেন, ‘অভিভাবকের মতো সব সময় পাশে থেকেছে আরিফ। কখনো একা হতে দেয়নি। অনুপ্রেরণা আর সাহস দিয়েছে।’

আরিফ বলেন, ‘বন্ধুদের বেশির ভাগই বিদেশে স্থায়ীভাবে চলে গেছে কিন্তু আমি কখনো চেষ্টাও করিনি। কারণ, আমার কাছে মনে হতো, নিজে ভালো থাকার যে আনন্দ, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দেশের জন্য ভালো কিছু করার। আমি সব সময়ই এমন কিছু করতে চেয়েছি, যাতে দুজন দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারব। তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি হবে।’ তিনি বলেন, সদাগরের ও সেলাইয়ের মাধ্যমে তাঁর কাজ শুরু হয়েছে। সদাগর আমদানিকারকদের পণ্যের জন্য নতুন বাজার সম্প্রসারণ করে নতুন হাজারো ক্রেতা খুঁজে আনবে, ব্যবসার পরিধি বাড়াবে, বিক্রয় বাড়াবে এবং বাজারজাতকরণের খরচ কমিয়ে আনবে, পাবে ন্যায্যমূল্য। আর সেলাই সমাজের নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য ক্ষমতায়নের কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এই দম্পতির মতে, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তনের মাধ্যমে সফলতা পাওয়া সম্ভব। কঠোর পরিশ্রম ও ইচ্ছা হতে পারে এই সাফল্যের চাবিকাঠি। হতাশ না হয়ে এগোতে হবে। সংসারে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর একপর্যায়ে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে যায়। এ সময় তৈরি পোশাক বিক্রির যে উদ্যোগ ছিল, তা বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর ওই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাঁরা ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন করেন। তৈরি করে পোশাক বিক্রির পরিবর্তে অন্যের উৎস থেকে পোশাক এনে বিক্রি শুরু করেন। মাঝে একবার সফটওয়্যার উদ্যোগ থেকে সরে গিয়ে চাকরিতে ফেরেন। কিন্তু স্বপ্ন তাঁদের অটুট ছিল। কিছুটা গুছিয়ে আবার ফিরে আসেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এবং সফলতা এবার শতভাগ আকারে ধরা দেয়।