Thank you for trying Sticky AMP!!

পাচারের টাকা ফেরত আনার সুযোগ কার বুদ্ধিতে: প্রশ্ন অর্থনীতিবিদের

মোস্তাফিজুর রহমান

পাচারের টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ এবং ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে একই পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা ও মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। সরকারের এসব নীতি নির্ধারণে কারা বুদ্ধি দেয়, তা জানতে চান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এসব সিদ্ধান্ত নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে গতকাল শনিবার এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলন হয়।

অনুষ্ঠানে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ব্যাংকের ঋণখেলাপির কথা বলছি। কিন্তু ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দুজন পরিচালকের জায়গায় চারজন থাকতে পারবেন—এই নিয়ম করার বুদ্ধি কারা দিয়েছিলেন? এই পরিচালকেরা ৬ বছরের জায়গায় ৯ বছর থাকতে পারবেন—এটা করার বুদ্ধি কারা দিয়েছিলেন? চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার বুদ্ধি কারা দিয়েছিল? এত বড় একটা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে কত টাকা জমা হলো? বলা হচ্ছে, প্রতিবছর ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি টাকার মতো টাকা বিদেশে চলে যায়। এই টাকা দেশে থাকলে তো আমাদের রিজার্ভের কোনো সংকট হতো না। তাহলে সরকারকে এই বুদ্ধিগুলো কে দিয়েছিল?’

অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। তাঁরা কেউ এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।

সুদের হার বৃদ্ধি এখনই নয়

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন সুদের নয়-ছয় সীমা সম্পর্কে সালমান এফ রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর বক্তব্য জানতে চান। জবাবে সালমান এফ রহমান বলেন, সুদহার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি কমবে—এই পুস্তকীয় সমাধান সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে, ডলার কিনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। প্রতিটি দেশ যার যার পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশও সেটাই করছে।
সালমান এফ রহমান বলেন, সুদের হার তুলে দিলে তাতে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী প্রভাব পড়বে। ১৬-১৭ শতাংশ সুদহার দিয়ে কোনো স্থানীয় শিল্প বাঁচতে পারবে না।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, দেশের সার্বিক সঞ্চয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুদের হার ঠিক করা হয়। আবার মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিও দেখা হয়। মূল্যস্ফীতি কতটা সহনীয়, তার ওপর নির্ভর করে। সুদের হার কম হলে অনেক সময় ভুল জায়গায় বিনিয়োগ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংক খাতের কার্যকারিতা কমে যায়। মুদ্রা বিনিময় হার সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন একই হার থাকা উচিত নয়। তিন–ছয় মাস পরপর মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করা উচিত।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি (সাবসিডি) নিয়ে অনেক কথা হয়। ভর্তুকির বিষয়টি এসেছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ (কম্পিটিটিভ) বাজারের ক্ষেত্রে। যেখানে প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে ভর্তুকির প্রসঙ্গ কেন আসবে। যেসব ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা নিয়ে উন্নত দেশগুলো অনেক কথা বলে। বর্তমান সংকটে তারাই এখন বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে।

সংকটে বাজেট অপ্রাসঙ্গিক

চলমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরের বাজেট পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘অর্থবছরের পাঁচ মাস পার হওয়ার পর দেখছি, যেসব নীতি নেওয়া হয়েছে বা লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, সেগুলো বদলে গেছে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আজকের এই সমস্যা, তা ঠিক নয়। এটি আসলে একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অর্থনীতির সমস্যা যেমন, নিম্ন কর-জিডিপি, সরকারি খরচের কম কার্যকারিতা, জ্বালানি খাতের দুর্বলতা, মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ ইত্যাদির কারণে বর্তমান সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘সরকার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটাতে কাজ করছে। তবে বাজারে এই বিশ্বাসটা তৈরি হয়নি। আমার মনে হয়, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রকাশ করে জনগণকে জানানো উচিত, আমরা কোন অবস্থায় আছি, কী করছি এবং কোথায় যাচ্ছি।’

আইএমএফের দুই শর্ত

সংবাদমাধ্যমে নানা শর্তের কথা বলা হলেও আইএমএফের দুটি শর্ত আছে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান। শর্ত দুটি হলো কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আগামী মার্চ নাগাদ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পেতে শুরু করব। আগামী সপ্তাহে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) সঙ্গে ২৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষর হবে। আমাদের এখন ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বেশ ভালো।

পরিকল্পনাসচিব মো. মামুন আল রশীদ বলেন, বর্তমানে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার মতো প্রকল্প আছে। এর মধ্যে জ্বালানি বাদ দিলে থাকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো। বর্তমানে পদ্মা সেতু বা রূপপুরের মতো নতুন কোনো বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা নেই। সুতরাং বড় প্রকল্প নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো বিষয় নেই।

ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকেরা  

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই, এমন কথা ছড়ানো হয়েছে। সাধারণ গ্রাহক আতঙ্কে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। ব্যাংক সবাইকে টাকা দিতে পেরেছে। এখন গ্রাহকেরা আবার টাকা ব্যাংকে রাখতে শুরু করছেন। একটি মহল সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

আইএমএফ সম্পর্কে তিনি বলেন, ভালো গ্রাহকদের ডেকে ডেকে ঋণ দেয় ব্যাংক। কয়েক মাস আগে আইএমএফের নিয়মিত একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল। তখন তারাই বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। যেহেতু ডলার নিয়ে একটা অস্থিরতা চলছে, তাই বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ নিতে রাজি হয়েছে।

গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন বলেন, ‘গ্যাস নিয়ে আমরা এখনো সমস্যায় আছি। শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদন বাড়াতে না পারলে ডলার–সংকট বাড়তে পারে।’ রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কর আদায় বাড়াতে হলে রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার করা খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এটা ব্যবস্থাপনার সমস্যা। বিকাশ, নগদ—এসবের মাধ্যমে হুন্ডির টাকা আসে। এখানে কঠোর হলে ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। কারণ, ব্যাংক আয়করের সনদ চাচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকে টাকা নেই। মানুষ বালিশের নিচে টাকা রাখছে।’

এ বিষয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, জ্বালানিসংকট নিয়ে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে ইতিমধ্যে সরকার সংলাপ শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরাও বেশি দাম দিয়ে জ্বালানি কিনতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

আরও যা বললেন

অনুষ্ঠানে দেশের চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। বর্তমান লেনদেনের ভারসাম্যের (বিওপি) চাপ কমানোর জন্য নয়-ছয় সুদের হার বাতিল করার পক্ষে মত দেন তিনি। সাদিক আহমেদ রাজস্ব খাতে সংস্কারের জন্য একটি রাজস্ব কমিশন গঠনের সুপারিশ করেন।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, জ্বালানি খাতের অনিয়ম, অর্থ পাচার—এগুলো ঠিক করতে না পারলে কর-জিডিপি বাড়ানো যাবে না। অর্থনীতিতে বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ‘জ্বালানি খাত নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কারণ, আইএমএফ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি না দেওয়ার শর্ত দিলে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও কম দামে জ্বালানি তেল গ্রাহকদের দিতে পারব না।’
অনুষ্ঠানে রপ্তানি বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনার কথা বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার। তিনি বলেন, যেসব বাণিজ্যিক নীতির কারণে তৈরি পোশাক খাতে সফলতা এসেছে, সে ধরনের নীতি অন্যান্য নন-গার্মেন্টস খাতেও প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, শহুরে গরিবদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু বয়স্ক গরিব নয়, সব শ্রেণির মানুষকে দারিদ্র্যের বাইরে আনতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘২০০৭ সালে আমরা ডলার নিয়ে বসেছিলাম, কিন্তু আমরা চাল পাইনি। ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম। তারা সকালে চালের দাম যত ডলার চেয়েছিল, বিকেলে ৫০ ডলার বেশি চেয়েছে। পরদিন সকালে আরও ৫০ ডলার বেশি চেয়েছিল।’  

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর কথা। কিন্তু যে পরিমাণ শস্য আমদানি করা হয়, তার তুলনায় আমাদের ব্যবহারযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক কম। সুতরাং আমদানির ক্ষেত্রে একটা নির্ভরতা থাকবেই।’ এ জন্য রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।