Thank you for trying Sticky AMP!!

গরিবের টাকায় ধনীর ভাগ

>৫০ লাখ দুস্থ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ দুর্নীতির কারণে এখনো সফল হয়নি। গরিবের তালিকায় নাম ধনীদেরও।

রাজশাহী মহানগর কৃষক লীগের সহসভাপতি মুর্শিদ কামাল শহরের একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। বসবাস করেন রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানার লক্ষ্মীপুর এলাকায়। লক্ষ্মীপুর বাজারে তাঁর দোকান আছে। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের ভাড়া পান। গত ঈদের আগে তিনি আড়াই হাজার টাকা নগদ সহায়তা পান।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে মুর্শিদ কমাল বলেন, তাঁর নাম কীভাবে তালিকায় গেল, নিজেও বুঝতে পারছেন না। কারণ, তিনি তাঁর নাম কাউকে দিতে বলেননি। তবে এসে যেহেতু পড়েছে, তাই টাকা তুলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ফেরত পাঠাবেন।

এটি হচ্ছে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য আড়াই হাজার করে এককালীন নগদ টাকার বিতরণচিত্রের একটি উদাহরণ। একইভাবে বিভাগীয় শহরটির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি পরিবার পেয়েছে আড়াই হাজার টাকা, যে পরিবারের মালিকের তিনতলা বাড়ি রয়েছে এবং যিনি শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস করেন।

তবে সরকারি সহায়তাব্যবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি এ দেশে নতুন নয়। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল, তারও অন্যতম কারণ ছিল দুর্নীতি। এর ওপর কাজ করে অর্থনীতিতে নোবেলই পেয়ে গেলেন অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের মূল তত্ত্ব হচ্ছে, খাদ্যের অভাবে নয়, দুর্ভিক্ষ আসে যথাযথ বিতরণব্যবস্থার অভাবে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক হতে চললেও সেই ত্রুটিপূর্ণ বিতরণব্যবস্থা থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং আরও প্রকট হয়েছে।

করোনায় হঠাৎ বিপদে পড়া ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে এ অর্থ বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৫০ লাখ পরিবারের তালিকা তৈরির। গত ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী এ নগদ সহায়তা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

অর্থ বিতরণ শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, পুরো তালিকাই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ যাঁরা টাকা পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের বদলে তালিকায় ঢুকে পড়েছেন তুলনামূলক সচ্ছল মানুষেরা। অথচ এ টাকা পাওয়ার কথা রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক, পোলট্রি খামারের শ্রমিক, বাস-ট্রাকের পরিবহনশ্রমিক, হকারসহ নানা পেশায় যুক্ত গরিব মানুষের।

মাঠ প্রশাসনের তৈরি তালিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে তদন্তে নামে। তদন্তে অর্থ বিভাগ প্রমাণ পেয়েছে, সরকারি কর্মচারী, পেনশনভোগী এবং পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের মালিকেরাও রয়েছেন সরকারি সহায়তা নেওয়ার তালিকায়। অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সুবিধা ভোগ করছেন, এমন অনেকেও আছেন। এ অবস্থায় অর্থ বিভাগ একটি অবস্থানপত্র তৈরি করে গত ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তালিকার সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ, সব বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিসিকে আলাদা চিঠি দিয়ে তালিকা সংশোধনের কথাও জানায় অর্থ বিভাগ।

অর্থ বিভাগের অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা দুই মাস আগেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ টাকা বিতরণের খরচের জন্যও বরাদ্দ রয়েছে ৮ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকা পেয়েছেন ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৬ জন। আর ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৩১১ জন পাবেন বলে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই টাকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

বহুমাত্রিক অনিয়ম, ৫ লাখ বাদ

তথ্য যাচাই করে অর্থ বিভাগ ৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০০ জনকে পুরোপুরি বাদ দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিন হাজারের মতো সরকারি কর্মচারী ও সাত হাজারের মতো পেনশনভোগী রয়েছেন। আর আছেন পাঁচ লাখের বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে রাখা ৫৫৭ জনের নাম। এটি এমনই তালিকা হয়েছে যে এতে এক লাখের বেশি লোক আছেন, যাঁরা অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকেও সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রায় তিন লাখ ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের নাম রয়েছে একাধিকবার।

এখানেই শেষ নয়, প্রায় ২৩ লাখের তথ্য নানা ধরনের অসংগতিতে ভরা। আবার ৮ লাখ ৩০ হাজার ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত মুঠোফোন নম্বর নেই। অন্য আট লাখের এনআইডি বা স্মার্ট কার্ডের নম্বর ও তাতে দেওয়া জন্মতারিখের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে থাকা তথ্যের কোনো মিল নেই। ছয় লাখের বেশি ব্যক্তির এনআইডির বিপরীতে যে মুঠোফোন নম্বর দেওয়া আছে, টাকা পাওয়ার তালিকায় দেওয়া মুঠোফোন নম্বর থেকে তা আলাদা। আর ১৯ হাজার ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট পেশা উল্লেখ নেই।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যসহায়তায় এ রকম হয় বলে আমরা দেখেছি। নগদ আড়াই হাজার টাকার ক্ষেত্রেও যে একই ঘটনা হবে, ভাবতে পারিনি।’

সায়মা হক আরও বলেন, তবে এটা যেহেতু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং বাজেটে এ খাতে বড় একটা অঙ্ক বরাদ্দ রাখা হয়, ফলে এ খাতে স্বচ্ছতা আনাটা জরুরি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এ টাকা জনগণের টাকা, করের টাকা। এই টাকা হরিলুট হতে দেওয়া যাবে না।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তির কথা প্রায়ই বলা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকের জন্য ত্রাণ হিসেবে কম্বল আসে দেশে। জনপ্রতি একটি করে কম্বল এলে তাঁরও একটি থাকার কথা। সেটি কই? দুর্নীতিবাজদের প্রতি আক্ষেপ করে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘সবাই পেল তেলের খনি, সোনার খনি, আর আমি পেলাম চোরের খনি।’