Thank you for trying Sticky AMP!!

টিকে থাকার ক্ষমতা দেখলাম

শামস মাহমুদ

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ভালো করেছে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।

২০২০ সালে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে শুধু করোনাভাইরাস নয়, আমরা ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আঘাতও দেখেছি। অনেক দেশের অর্থনীতি শুধু করোনার আঘাতেই সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ তিনটি ধাক্কা সামলেও সামনে এগিয়েছে। এটা টিকে থাকার পুরোনো সক্ষমতার প্রমাণ।

সর্বশেষ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের বেসরকারি খাত ভালো করেছিল। চড়া সুদের যুগেও বেসরকারি খাত মুনাফা করেছে। বড় হয়েছে। রানা প্লাজার মতো একটি দুর্ঘটনার পরও রপ্তানি খাত টিকে গেছে। আরও ভালো করেছে। এবার করোনার মধ্যেও আমরা সেই টিকে থাকার ক্ষমতাই দেখলাম।

একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় গত মার্চের শেষ দিকে। ফলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়টি খুব খারাপ গেছে বলা যায়। ২৬ মার্চ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় বড় শিল্পের পাশাপাশি কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (সিএমএসএমই) খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণা অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে ৬১ শতাংশ ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এমনকি আগস্ট মাসেও ৫০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের ৫০ শতাংশের কম সক্ষমতায় খোলা রাখতে হয়েছিল। এতে তাদের আয় ও নগদ অর্থের সরবরাহে ব্যাপক টান পড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসএমই খাতে সামগ্রিকভাবে আয় কমেছে প্রায় ৬৬ শতাংশ এবং প্রায় ৭৬ শতাংশ উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত ছিল।

কিন্তু জুলাই থেকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ভালোর দিকে যেতে শুরু করে। আমরা দেখছি, রপ্তানি আয় বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ কাজ করেছে। পণ্যের সরবরাহ মোটামুটি ঠিক ছিল। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাধা পায়নি। কৃষি খাতে প্রধান ফসলগুলোর আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। রপ্তানি খাত উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পেরেছে। বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে আমরা পড়িনি। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো ছিল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ছয় মাস দেখতে হবে।

সরকার করোনার শুরুতেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলা ও পুনরুদ্ধারের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এটি অর্থনৈতিক ক্ষতি সামাল দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল বেশি পেয়েছে রপ্তানি খাত ও অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। ছোটরা ততটা পায়নি। সিএমএসএমই করোনা বিপর্যয়জনিত ক্ষতি এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে শিল্প ও সেবা খাতের জন্য রাখা হয়েছে ৮০ শতাংশ এবং ট্রেডিং ব্যবসার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ শতাংশ। যদিও ট্রেডিং ব্যবসার সংখ্যাই ছিল বেশি। এই ২০ হাজার কোটি টাকা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সময়সীয়া বেঁধে দিয়েছিল ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু ব্যাংকগুলো ২৭ হাজার ৮০৬ জন ঋণগ্রহীতাকে মাত্র ৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে সমর্থ হয়েছে (১৫ অক্টোবর পর্যন্ত), যা মোট প্রণোদনার মাত্র ২৬ শতাংশ।

সিএমএসএমই ব্যবসার একটি বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, যাদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত। এ খাতকে টেকসই ও বিকশিত করতে বর্তমান প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেওয়ার সময়সীমা বাড়াতে হবে এবং ঋণ সহজ করতে হবে। নথিগত সমস্যা, জামানতের অভাব ও সুসম্পর্কের অভাবে ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলো সিএমএসএমই খাতে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। এ খাতে ঋণ দেওয়ার ব্যয় অনেক বেশি বলেও দাবি করছে তারা। এ ছাড়া সিএমএসএমইর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যভান্ডার না থাকায় এই প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা অনেকেই নিতে পারছে না। শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ কিছুটা পেলেও জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের অনেকেই এই ঋণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না।

তাই সিএমএসএমই খাতের বিকাশে বর্তমান প্রণোদনা প্যাকেজের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা প্রয়োজন। সেটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথম প্যাকেজের আওতার বাইরে থাকা রেস্তোরাঁ, পর্যটন, এভিয়েশন, তথ্যপ্রযুক্তি, খুচরা ব্যবসা ও অনানুষ্ঠানিক খাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলোকে ঋণ দেওয়া যেতে পারে।

করোনার শুরুর দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কী কী প্রভাব পড়বে, সেটা নিয়ে ধারণা করে কাজ করতে হয়েছে। এখন আমরা জানি কী প্রভাব পড়েছে, সেটা কতটুকু গভীর। আমাদের কাছে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অভ্যন্তরীণ খাতকে চাঙা রাখতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া একান্ত জরুরি। আসছে শীতে করোনার প্রকোপ বেড়ে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য যেন ক্ষতির মুখে না পড়ে, সেটি দেখতে হবে।

রপ্তানি খাতের একটি ভালো দিক হলো, ব্র্যান্ডগুলো এখন তুলনামূলক কম দামে, পোশাক কম খরচে তৈরি করার দিকে নজর বেশি দেবে। এতে বাংলাদেশ বাড়তি ক্রয়াদেশ পেতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ বাড়তি ক্রয়াদেশ পাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে আমি সুসময়ই দেখছি।