Thank you for trying Sticky AMP!!

সংস্কার না হলে ফল মিলবে না: জাহিদ হোসেন

জাহিদ হোসেন

অগ্রাধিকারভিত্তিক সংস্কার না হলে এই অর্জনযোগ্য বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। বাস্তবায়ন হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। অগ্রাধিকারের সংস্কারগুলো হলো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, ঘাটতি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা, কর প্রশাসন, সরকারি বিনিয়োগের ব্যবস্থাপনা।

এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়, খরচ, ঘাটতি—এসব খাতে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নয়। তবে অভিলাষী ও অর্জনযোগ্য বাজেট হয়েছে, যা অতীতের বাজেটের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এটি বাজেটের ইতিবাচক পরিবর্তন, যা বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্তদের উজ্জীবিত করবে।

বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এই ঘাটতি সহ্য করার মতো ক্ষমতা এই অর্থনীতির আছে। কেননা ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেশি নয়। চ্যালেঞ্জ হলো, ঘাটতির অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হবে? এটি নিয়ে সরকার উভয়সংকটে আছে। বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এই ঘাটতি মেটানো হবে। এটি বেশির ভাগই সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতা। এবারের বাজেটের লক্ষণীয় দিক হলো, সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থায়নের লক্ষ্য কমানো হয়েছে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থায়নের লক্ষ্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। দুই বছর আগে হলে আমি সাধুবাদ জানাতাম। কিন্তু এখন ব্যাংকে তারল্যসংকট আছে। এমন সময়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে বড় ঋণের পরিকল্পনা করেছে সরকার, যখন তারল্যের টানাপোড়েন আছে। এটি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অর্থায়নের সংকট হলে সার্বিক বিনিয়োগ ও উৎপাদনে সমস্যা হবে।

ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট মূলত তিনটি কারণে। এগুলো হলো অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ, আমানত সংগ্রহের দুর্বল প্রবৃদ্ধি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত ডলার বিক্রি। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি বন্ধ করতেই হবে। এটি ব্যাংক খাতের সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। অথচ বাজেটে এই খাতের সংস্কারের কথা জোরালোভাবে বলা হয়নি। ঋণখেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করতে আইনি দুর্বলতার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন যুগোপযোগী করতে হবে। বাজেটে শুধু একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলা হলো। বিষফোড়া অনেক বড় হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে সার্জারি করা প্রয়োজন। কী ধরনের সার্জারি করতে হবে, তা অজানা নয়। কবে কীভাবে করা হবে, সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, এবারের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ১৭ শতাংশের মতো বেশি। এটি অর্জনযোগ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য ২০১২ সালের ভ্যাট আইন প্রস্তুত ছিল। সেই ভ্যাট আইন তো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, যা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা বেশ সংশোধিত। অনেক ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, একাধিক ভ্যাট হার করা হয়েছে। এই ভ্যাট আইন রাজস্ব আদায়ে খুব বেশি অবদান রাখবে বলে মনে হয় না। ২০১২ সালের মূল আইনে ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বহুস্তর ভ্যাট হার, ভ্যাট অব্যাহতি থাকায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ রয়েই গেল। এ ছাড়া করপোরেট কর হার কমানো উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে করপোরেট কর কমাতে হবে। এখন উচ্চ হারের করপোরেট কর রয়েছে, যা অযৌক্তিক।

বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা সৎ করদাতাদের কর দিতে নিরুৎসাহিত করবে। কারও যদি ১ কোটি টাকা আয় হয়, তাহলে প্রায় ৩০ লাখ টাকা কর দিতে হয়। আর ১ কোটি টাকা সাদা করতে মাত্র ১০ লাখ টাকা কর দিতে হবে। এ ধরনের সুবিধা যত দ্রুত বন্ধ করা যায়, ততই অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। এবারের বাজেটে মোবাইল ফোনের সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে। এমন একটি উদীয়মান প্রযুক্তি খাতের বিকাশে যখন আরও সহায়ক সংস্কার দরকার ছিল, তখন উল্টো কাজ হলো।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে রাজস্ব খাতে যে সংস্কারের কথা বলেছেন সেটি হলো, করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করবেন। এ জন্য উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কর অফিস বিস্তৃত করবেন। কিন্তু এই উদ্যোগ এক বছরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কর প্রশাসনের অটোমেশনের প্রকল্প এগোচ্ছে ধীর গতিতে। ভ্যাটের ই-ফাইলিং শুধু বড় করদাতাদের জন্য করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কর প্রশাসনের দক্ষতা না বাড়ালে এবং বড় ধরনের আইনি সংস্কার না হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে না।

যদি রাজস্ব লক্ষ্য অর্জিত না হয়, তবে সরকারের ব্যয়ের ওপর চাপ বাড়বে। বর্তমানে অবকাঠামো ও মানবসম্পদে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ আছে। প্রায় সব খাতে আনুপাতিক বরাদ্দ একই রকম।

এবারের বাজেটে কিছু নতুন খরচ যুক্ত করা হয়েছে। এই বাড়তি খরচ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করা হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্সের ভর্তুকি দেওয়ার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এই দুটি খাতে প্রণোদনা দেওয়ার অর্থনৈতিক কোনো যুক্তি নেই। কেননা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি—দুটোতেই বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি আছে। এর পরিবর্তে মুদ্রা বিনিময় হারে সংস্কার এনে এই দুটো খাতকে সুবিধা দেওয়া যেত। এই দুটি খাতের চেয়ে বরং আরও কিছু বেশি অগ্রাধিকার খাত আছে। কৃষকেরা মার খাচ্ছেন। বাম্পার ফলনের পরও তাঁরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এই সময়ে তাঁদের সহায়তা দেওয়া বেশি প্রয়োজন ছিল। তাহলে অগ্রাধিকার কোনটি?

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন যদি না বাড়ে, কর্মসংস্থান হবে না। বৈষম্যও কমবে না। তাই সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার প্রয়োজন। এবারের বাজেটে প্রকল্প পরিচালকদের অর্থ খরচের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু এটি প্রকল্প বাস্তবায়নের একমাত্র সমস্যা নয়। জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, প্রকল্প পরিকল্পনা গলদ, ঠিকাদারদের কাছে জিম্মি হওয়া—এসব সমস্যাও আছে। এগুলো বিষয়ে বাজেটে কোনো বক্তব্য নেই। এসব সমস্যার কারণে প্রকল্পের খরচ বাড়ে, সময় বাড়ে।