Thank you for trying Sticky AMP!!

গ্রুপভুক্ত ঋণখেলাপিদের ছাড়, কার স্বার্থ রক্ষা করবে 

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার এক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে। 

ঋণখেলাপিরা কার্যত আবারও ছাড় পাচ্ছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখন থেকে নতুন করে ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি, নাকি যৌক্তিক কারণে খেলাপি হয়েছে, ব্যাংক তা দেখবে। আর এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপন জারির পর ঋণখেলাপিরা প্রকাশ্যে উল্লাস করেছেন, এমন খবর হয়তো নেই। তবে তাঁদের হাসিমুখ কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ নেওয়ার পথ শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো, যেভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি হয়েছে। ঋণখেলাপি গ্রাহকদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তন এনে। গত জুলাইয়ে যখন সংসদে এটি পাস হয়, তখন তাতে অতিরিক্ত সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিলেন সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য, যিনি বর্তমানে সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। 

শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী আইন পরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, সেই প্রমাণও বের করবে এবং এরপর ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাবে। 
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক 

জাতীয় সংসদের ফ্লোরে কোনো আইনে সংশোধনী আনা একটি সাধারণ ঘটনা। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনী আনতে আহসানুল ইসলামের প্রস্তাব কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। ঠিক আগের মাসে, অর্থাৎ জুনে কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে একই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। ওই প্রস্তাবে তাঁরা বলেছিলেন, ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি না হলে বা যুক্তিসংগত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে, সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে না। ব্যাংক পরিচালকেরা যখন এই প্রস্তাব জমা দেন, তখন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় এমন কোনো ধারা ছিল না। অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সংসদে যে মতামত পেশ করে, তাতেও ব্যাংক পরিচালকদের প্রস্তাবটি স্থান পায়নি। পরে আইনটি আহসানুল ইসলামের আনা সংশোধনীসহ পাস হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের সহযোগী কোম্পানিকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। তবে মন্দের ভালো যে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পালনের জন্য তারা ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। আর অনুমোদন দেওয়ার চূড়ান্ত দায়িত্ব নিজের হাতেই রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর বিশেষজ্ঞরা পাচ্ছেন না, তা হলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত হবে কীভাবে। তাত্ত্বিক সংজ্ঞায়, ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাঁরাই, যাঁরা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণের টাকা পরিশোধ করেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করা কঠিন কাজ, তবে তাঁর উদ্বেগ অন্য জায়গায়। তাঁর মতে, শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী আইন পরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, সেই প্রমাণও বের করবে এবং এরপর ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাবে। ওই গোষ্ঠীর ক্ষমতার প্রতিফলন দেখছেন মুস্তফা কে মুজেরী।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে পরিস্থিতি সম্ভবত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে গত দেড় দশকে। ২০০৯ সালে বর্তমানের শাসক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু কম। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় সাড়ে ৬ গুণ হয়েছে।

তবে খেলাপি ঋণের এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ব্যাংকিং খাতে ‘ডিসট্রেসড অ্যাসেট’ বা বিপর্যস্ত সম্পদের পরিমাণ এখন তিন লাখ কোটি টাকা। আর ঋণখেলাপিদের একের পর এক ছাড়, স্বজনতোষী নীতি আর গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার পথে হেঁটে হেঁটে এই পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে দেশের ব্যাংকের খাত।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি ধরার চেষ্টা ভারত ও পাকিস্তানে হয়েছে। কিন্তু খুব একটা ফলাফল আসেনি। টাকা ফেরত না দিয়ে ২০১৭ থেকে ২০২০—এই ৩ বছরে ভারতের ৩৫ জন ঋণখেলাপি উল্টো দেশ ছেড়েছিলেন। গত বছরের গোড়ার দিকে ভারতের ৫০ শীর্ষ ইচ্ছাকৃত খেলাপির কাছে ব্যাংকের পাওনা ছিল ৯২ হাজার কোটির রুপি। আগের ১০ বছরে ভারতে ১০ লাখ কোটি রুপির ঋণ অবলোপন হয়েছে। কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি রুপি। গত সেপ্টেম্বরে তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আরও কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে বলা হয়, ২৫ লাখ রুপির বেশি ঋণ নেওয়া কেউ ঋণ পরিশোধ না করলে তাঁর সব হিসাব পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিতে ভালোবাসেন, দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে বলেও মাঝেমধ্যে বড়াই করেন। সিঙ্গাপুরে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সাত বছরের জেল, দেড় লাখ ডলার জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা বলা যাক। ঋণের অর্থ উদ্ধারে সে দেশের কর্তৃপক্ষ ঋণগ্রহীতার সব সম্পদ জব্দ করতে পারে। কী কারণে গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, সে ব্যাপারে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারলে তার আদালতে যাওয়ার পথও সংকুচিত হয়ে যায়।

গত মাসে অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে একটি নীতিমালা করেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করতে ৯ এপ্রিলের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ইউনিট গঠন করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে গোষ্ঠী নিজেদের মতো করে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন পরিবর্তন করাতে পারে, তারা আইনের জালে আটকা পড়বে, এমন প্রত্যাশা সম্ভবত কম মানুষই করেন। ঋণখেলাপিদের নতুন সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দৃশ্যত পেছন দিকেই হাঁটছে।