Thank you for trying Sticky AMP!!

রিজার্ভের অর্থ প্রকল্পে ব্যবহার নয়, ৯% সুদহার নিয়েও আপত্তি

  • রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব দিতে বাংলাদেশের সম্মতি।

  • শর্ত মানলে রিজার্ভ হবে ২৭ বিলিয়ন ডলার।

  • বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ।

বাংলাদেশ ব্যাংক

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। প্রকৃত তথ্য দিতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এর ফলে রিজার্ভ একেবারে কমে যাবে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার বা ৮ বিলিয়ন ডলার। গত বুধবার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। এর ফলে রিজার্ভ কমে হবে ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

পাশাপাশি রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানিকারকদের জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ। বর্তমানে এ তহবিলের আকার ৭০০ কোটি ডলার বা ৭ বিলিয়ন ডলার। চাহিদা বাড়ায় গত মার্চে তা ৬ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৭ বিলিয়ন করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (বিআইডিএফ) কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন না করতে বলেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দিনভর বৈঠক করেছে সফররত প্রতিনিধিদল। এ সময় ব্যাংক খাতের সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দিনভর বৈঠকে ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল এ পরামর্শ দিয়েছে। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ব্যাপারে আলোচনা করতেই দলটি এখন ঢাকায়। আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং আগামী ২ ও ৮ নভেম্বর আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সভার সূচি রয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফ অর্থনীতি ও ব্যাংকের বিভিন্ন সূচক নিয়ে তথ্য জানতে চেয়েছে। তারা কিছু বিষয়ে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মিলবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংস্থাটির আরও সভা হবে।’

সুদহারের সীমা প্রত্যাহার

আইএমএফের প্রতিনিধিদল গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সঙ্গে বৈঠক করে। এতে মুদ্রানীতির কাঠামো পরিবর্তনের পরামর্শ দেয় সংস্থাটি। রিজার্ভ মানির ওপর সীমা আরোপ ও সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ারও পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি বন্ডের বাজার উন্নয়ন ও সঞ্চয়পত্রের সংস্কার আনতে বলে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহারের সীমা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়াতে পারছে না, আমানতে বেশি সুদ দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের সুদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা পড়েছেন চরম বিপাকে। কমছে ব্যাংকের আমানতও।

সংস্থাটি বাংলাদেশ ব্যাংককে বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছে। পরে বছরে চারবার ঘোষণা করতে বলেছে। মুদ্রানীতির সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা তুলে ধরতে বলেছে সংস্থাটি। তাদের পরামর্শের মধ্যে আরও রয়েছে সরকারের ব্যাংকঋণের তথ্য প্রতি তিন মাস অন্তর প্রকাশ।

ভাসমান বিনিময় হার

গতকাল বেলা ১১টায় ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও সাজেদুর রহমান খানের সঙ্গে সভা করে প্রতিনিধিদল। এরপর সভা করে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে। এসব সভায় লেনদেন ভারসাম্য ও বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আমদানি কমছে, রপ্তানি বাড়ছে। প্রবাসী আয়ও বাড়বে। ফলে পরিস্থিতি উত্তরণ হয়ে যাবে। এ ছাড়া তেল আমদানি চিত্র ও বিদেশি বিনিয়োগের পূর্বাভাস তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব সভায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলটি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হারের ওপর জোর দেয়। এরপর জানতে চায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৭ টাকা দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের দাম ১০০-১০৩ টাকা বলা হচ্ছে। ফলে ডলারের প্রকৃত দাম কোনটি।

এ সময় প্রতিনিধিদলটি প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা তুলে দিয়ে ডলারের দাম আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেয়। এতে প্রবাসী আয় বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। পাশাপাশি বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা স্থায়ী করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে এখন ব্যাংকগুলো জোটবদ্ধ হয়ে প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম দিচ্ছে ১০৭ টাকা। আর রপ্তানি আয় নগদায়ন করছে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে।

রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন

রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে সংস্থাটি সভা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেজারি ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে। এ সময় রিজার্ভের হিসাবায়নে মোট রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কথা বলা হয়। রিজার্ভ থেকে কোন কোন বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ হিসাব করতে হবে, তা–ও আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সম্মত হয়েছে। ফলে এখন থেকে আইএমএফের কাছে তথ্য পাঠানোর সময় প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য পাঠানো হবে। এক বছর আগেও দেশে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। আমদানি খরচ বাড়ায় যা এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার (৭ বিলিয়ন) দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার বা ৮ বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফ বলছে, এসব বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব করতে হবে। কারণ, রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। আইএমএফের শর্ত মানলে রিজার্ভ কমে হয় ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও বলেছে, ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত মান বের করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকের খারাপ হয়ে যাওয়া সম্পদের তথ্য নিয়মিত প্রকাশ এবং ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরাপত্তা সঞ্চিতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রথা অনুসরণ করতে হবে। বড় ব্যাংকগুলাকে আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ, খেলাপি ঋণ কমাতে কৌশল প্রণয়ন এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে ও মূলধন বাড়াতে সমঝোতা চুক্তি অব্যাহত রাখতে হবে।

বৈঠকে আইএমএফকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া ১০ ব্যাংকের সঙ্গে বিশেষ চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ইতিমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে সভা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

এদিকে করোনার কারণে ব্যাংক খাতে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তুলে নিতে বলেছে সংস্থাটি। করোনার কারণে ঋণ পরিশোধে ছাড়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা সুবিধা দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাচ্ছে না।