Thank you for trying Sticky AMP!!

ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’

ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বরে তুলে নেওয়া হয়েছে ২,৪৬০ কোটি টাকা।সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকে সন্দেহজনক ঋণ ৯,৫০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এভাবেই ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র।

সব মিলিয়ে নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা চলতি মাসকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ বলে অভিহিত করছেন।

একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এ কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার–সংকটের পর টাকার সংকট বড় আলোচনার বিষয়। ব্যাংক তিনটির নথিপত্র পর্যালোচনা করে এ সব তথ্য মিলেছে।

এভাবে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে ব্যবসায় ঋণ দিয়েছে, তা যথাযথ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থনীতি সংকটের সময় এমন বড় অনিয়ম হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওপরের নির্দেশের জন্য বসে থাকলে চলবে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

Also Read: ইসলামী ব্যাংকে 'শান্তিপূর্ণ' বদল

এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন চলছে। মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ঋণ নেওয়া এসব কোম্পানি। ফলে দ্রুত সময়ে এসব অর্থায়নের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।

নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ পরিশোধে বিরতি) দেওয়া হয়েছে এক বছর। ফলে এক বছরের মধ্যে কোনো অর্থ শোধ দিতে হবে না। এসব ঋণের ভবিষ্যৎ বুঝতে কমপক্ষে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। সূত্রগুলো জানায়, এসব ঋণের সুবিধাভোগী ব্যাংক তিনটির মালিকপক্ষই। যেসব কোম্পানির নামে টাকা তোলা হয়, তার মধ্যে একটির মালিকের ঠিকানা চট্টগ্রামে। আর বাকিগুলো রাজশাহীতে। বেশির ভাগ কোম্পানির নথিপত্রে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে।

রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্স মণ্ডল। গ্রুপের এমডি মো. আমিনুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহান নাবিল ফিড মিলের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন মোখলেছুর রহমান, আনোয়ার ইসলাম। আবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মিফতাহ উদ্দিনও রয়েছেন একটির মালিকানায়।

নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটের হিসাবে, গ্রুপটির কোম্পানির সংখ্যা ১৭। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাবিল নাবা ফুডস, ফ্লাওয়ার মিল, ফিড মিল, অটো রাইস মিল, ডাল মিল, কনজ্যুমার প্রোডাক্টস, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম ও নাবিল ট্রান্সপোর্ট।

সরেজমিন ঢাকা

নাবিল গ্রেইন ক্রপসকে ১ হাজার ১১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান সার্কেল-২ শাখা। এর মধ্যে গত ৬, ৭ ও ১৯ জুলাই দেওয়া হয় যথাক্রমে ২৯৩ কোটি, ৪৩১ কোটি ও ৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের নথিপত্রে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া বনানীর ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি আবাসিক ভবন। ভবনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসিক হওয়ায় এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ নেই।’

এই প্রতিবেদক ব্যাংকে গেলে গুলশান সার্কেল-২ শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে চলতি বছরের মার্চে শাখায় প্রতিষ্ঠানটির হিসাব খোলা হয়। এরপর যা নির্দেশ এসেছে, সেই মোতাবেক অর্থায়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে ধান সংগ্রহ করে শুধু চাল বানানো হয়। আর বাকি পণ্যগুলো বাইরে থেকে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এখানে গড়ে ময়দা উৎপাদন করা হয় দেড় শ টন, চাল ১০০ থেকে ১৫০ টন, ফিড (মাছ ও পোলট্রি) ১০০ থেকে ১৫০ টন ও মসুর ডাল ২০০ টনের মতো
মো. আয়নাল হক, নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সহকারী মহাব্যবস্থাপক

মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ১–১০ নভেম্বর সময়ে ৯৮১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখা। এর মধ্যে এক দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিন ১০৫ থেকে ১৬৫ কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের নথিপত্রে দেওয়া বনানীর ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে।

অফিসে উপস্থিত আল আমিন ও বুলবুল নামের দুই কর্মী জানান, মার্টস বিজনেস লিমিটেড নামে নাবিল গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সরেজমিনে আরও জানা গেল, সম্প্রতি পাশের ১১ নম্বর ভবনটি পুরোটাই কিনে নিয়েছে নাবিল গ্রুপ।

ঠিকানায় কোম্পানি নেই, এরপরও কেন ঋণ দিলেন—এ প্রশ্নের জবাব দেননি ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখার ব্যবস্থাপক আবদুর রব মৃধা। তিনি প্রথম আলোকে জানান, এসব বিষয়ে প্রধান কার্যালয় কথা বলবে। তাঁদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তিনি ২০২১ সালের জুলাই থেকে শাখার দায়িত্বে।

Also Read: ইসলামী ব্যাংক ছাড়ছেন বিদেশি মালিকেরা

সরেজমিন রাজশাহী

নাবা অ্যাগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে গত এপ্রিল ও জুলাই মাসে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা। ব্যাংকটির নথিপত্রে দেওয়া কোম্পানির ঠিকানা ১৫/২ আহমদনগর, রাজশাহী। সেখানে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। তবে এ ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের পাঁচতলা আবাসিক ভবন রয়েছে। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকেন। ভাড়াও দেওয়া আছে। একই ঠিকানা ব্যবহার করে নাবিল ফিড মিলস গত ২৭ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে নেয় ৬১ কোটি টাকা।

রাজশাহীর ঘোড়ামারা ২১/৪ শিরোইল, ঠিকানা ব্যবহার করে ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেস গত ৪-৬ সেপ্টেম্বর সময়ে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে নেয় ৫৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর ১৪২ কোটি টাকা, ৫ সেপ্টেম্বর ২৫০ কোটি টাকা এবং ৬ সেপ্টেম্বর ১৫৩ কোটি টাকা। এ ঠিকানায়ও এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ঝিকরাপাড়া ঠিকানা ব্যবহার করে নাবা ফার্ম লিমিটেড ইসলামী ব্যাংকের একই শাখা থেকে গত অক্টোবরের এক সপ্তাহে নেয় ৬৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ অক্টোবর দেওয়া হয় ১০৭ কোটি টাকা, ১১ অক্টোবর ৯৭ কোটি টাকা, ১৯ অক্টোবর ২৪৪ কোটি টাকা, ২৬ অক্টোবর ৫৩ কোটি টাকা এবং ২৭ অক্টোবর ১৩৮ কোটি টাকা। ওই ঠিকানায় নাবা ফার্ম লিমিটেড নামের একটি মুরগির খামার রয়েছে। যার ধারণক্ষমতা ৭ লাখ ২০ হাজার। এখন দৈনিক প্রায় দুই লাখ ডিম পাওয়া যায়।

Also Read: মালিকানা বদলের পর ১৫ মাসেই ইসলামী ব্যাংক সংকটে

রাজশাহীর খড়খড়ি বাইপাস এলাকার বামন শিখরের ঠিকানা ব্যবহার করে আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে গত জুলাই মাসেই ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা দেয় ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা। এ ঠিকানায় আনোয়ারা ট্রেডের কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নাবা ফার্ম লিমিটেডের একটি ডিম বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, এটি নাবিল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান।

রাজশাহীর পবা এলাকার ভেড়াপোড়া বাজারের ঠিকানা ব্যবহার করে রাজশাহী শাখা থেকে শিমুল এন্টারপ্রাইজ নেয় ১ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা, যা দেওয়া হয় গত জুলাই ও নভেম্বর মাসে। এর মধ্যে ২৪ জুলাই ৩৩৫ কোটি টাকা, পয়লা নভেম্বর দেওয়া হয় ২১৩ কোটি টাকা, ১৬ নভেম্বর ৫৩৪ কোটি টাকা এবং ১৭ নভেম্বর ৬১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

পবার ওই এলাকায় গিয়ে শিমুল এন্টারপ্রাইজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। বাজারের একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময়ের শিমুল এন্টারপ্রাইজই এখন নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নামে পরিচিত। এখানে নাবিলের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নাবিল অটো রাইস মিল, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, নাবিল ফিড মিলস, নাবিল কোল্ডস্টোরেজ, নাবিল ডাল মিল। বড় এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় ৩০০ জন। দৈনিক মজুরি বা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন এক হাজার থেকে দেড় হাজার জন।

নাবিল গ্রুপের ঋণ ৩-৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। তারা আমাদের বেশ পুরোনো গ্রাহক। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ট্রেডিংনির্ভর। এসব অফিস সাজানো–গোছানো হয় না। এ জন্য হয়তো ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। ইসলামী ব্যাংকে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ হয় না।
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা, ইসলামী ব্যাংকের এমডি

নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আয়নাল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বাংলাদেশ থেকে ধান সংগ্রহ করে শুধু চাল বানানো হয়। আর বাকি পণ্যগুলো বাইরে থেকে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এখানে গড়ে ময়দা উৎপাদন করা হয় দেড় শ টন, চাল ১০০ থেকে ১৫০ টন, ফিড (মাছ ও পোলট্রি) ১০০ থেকে ১৫০ টন ও মসুর ডাল ২০০ টনের মতো।

ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার আমানত ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং ঋণ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপকে ঋণ দিতে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় রাজশাহী শাখায় টাকা দিয়েছে। শাখার ঋণের মধ্যে শুধু নাবিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গেছে ৫ হাজার ১০ কোটি টাকা। এতে পুরো শাখাটি ওই গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

কোম্পানিগুলোর সবই নাবিল গ্রুপের কি না, তা জানতে চাইলে গ্রুপটির এমডি মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করি, এখানে লুকানোর কিছু নেই। যা আছে তার সবটাই ব্যাংক জানে। আমার ঋণের বিষয়ে ব্যাংক বক্তব্য দেবে।’

পিছিয়ে নেই ফার্স্ট সিকিউরিটি ও এসআইবিএল

নাবিল গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের পুরোনো গ্রাহকদের একজন। তবে অন্য ব্যাংকগুলোতে চলতি বছরেই গ্রাহক হয়। এসব ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার পর সব ব্যাংকেই গ্রুপটির ঋণ বেড়েছে হু হু করে। চলতি বছরের শুরুতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বনানী শাখায় হিসাব খোলে নাবিল গ্রুপ।

এরপর গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান নাবিল নাবা ফুডস, নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ গত জুনে ৫০০ কোটি টাকা ফান্ডেড (সরাসরি ঋণ) ও ৭০০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড (ঋণপত্র) সুবিধা দেওয়ার অনুমোদন দেয়। এরপর গ্রুপটি ফান্ডেড ঋণের ৩০০ কোটি টাকা নিয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি অর্থ নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

যখন ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপকে ঋণ অনুমোদন দেয়, তখন গ্রুপটির কাছে অন্য ব্যাংকের পাওনা ছিল ফান্ডেড ৩ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা ও নন ফান্ডেড প্রায় ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

এ নিয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাসুদুর রহমান শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাবিল আমাদের নতুন গ্রাহক। তবে এখন পর্যন্ত দেওয়া ঋণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। গ্রুপটির ব্যবসা ভালো চলছে। এ জন্য ঋণ অনুমোদন হয়েছে। তবে ঋণের টাকা ছাড় করতে গ্রুপটি অতটা আগ্রহী না। আমরা পর্যাপ্ত জামানত পাওয়া সাপেক্ষ ঋণ ছাড় করছি।’

চলতি বছরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখায় গ্রাহক হয় নাবিল নাবা ফুডস, নাবিল ফিডস লিমিটেড ও শিমুল এন্টারপ্রাইজ। গত জুলাইয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এ তিন গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ দেয়। এমন অর্থায়ন করতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা ধার দিয়ে রেখেছে ইসলামী ব্যাংক।

এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো, এ জন্য আমরাও অর্থায়ন করেছি। তবে অনুমোদিত সীমার পুরোটা এখনো দেওয়া হয়নি।’

কেন এমন অর্থায়ন

ইসলামি ধারার এই তিন ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছে মুরাবাহ টিআর পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতে পণ্য ক্রয়ের নথিপত্র থাকতে হয়। তবে ব্যাংকগুলোর কাছে পণ্য ক্রয়ের কোনো প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি অনানুষ্ঠানিক জানালেও তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। এর আগে এসব ব্যাংকে একাধিকবার অনিয়ম ধরতে গিয়ে ফিরেও এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এখন অনেকটা চুপ হয়ে গেছেন।

ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য একটি বড় গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক। গ্রুপটির পক্ষে এখন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাজমুল আহসান। আর ভাইস চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।

এ নিয়ে জানতে ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব বিষয় পর্ষদের সভায় আসে না। নিচ থেকেই অনুমোদন হয়ে যায়। পর্ষদে আসলে চেয়ারম্যান সাহেব মতামত দেন। তবে সবকিছু নিয়ম মেনে চলছে।’

ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাবিল গ্রুপের ঋণ ৩-৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। তারা আমাদের বেশ পুরোনো গ্রাহক। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ট্রেডিংনির্ভর। এসব অফিস সাজানো–গোছানো হয় না। এ জন্য হয়তো ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। ইসলামী ব্যাংকে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ হয় না। যা হচ্ছে, সবই নিয়ম মেনে হচ্ছে।’

ইসলামী ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো শিল্প গ্রুপগুলো ছিল ব্যাংকটির গ্রাহক। মালিকানা পরিবর্তনের সাত বছরের মাথায় ভালো গ্রুপগুলো ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর শীর্ষ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বল্প খ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে ব্যবসায় ঋণ দিয়েছে, তা যথাযথ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থনীতি সংকটের সময় এমন বড় অনিয়ম হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওপরের নির্দেশের জন্য বসে থাকলে চলবে না।’

(রাজশাহীর তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন করেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও শফিকুল ইসলাম)