Thank you for trying Sticky AMP!!

ডলারের চাহিদা কমেলেও সংকট কাটেনি, কিনতে হচ্ছে বেশি দামে

মার্কিন ডলারের নোট

গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তাঁরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফলে আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। ফলে নতুন করে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। তবে আগে আমদানি হয়েছে এমন দায়, বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও বিলম্বিত ঋণপত্রের দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি না বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বাড়েনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো ডলারের কেনাবেচার দাম নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফলে এই সীমার মধ্যে ডলারের দাম বাড়ছে। তবে এখন দাম বাড়ছে ধীরগতিতে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কাছে ডলারের দাম ১১০ টাকার বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কারণ, ব্যাংকগুলোকে কিছু ক্ষেত্রে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

Also Read: ডলার–সংকট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চান ব্যবসায়ীরা 

এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এত চাপ ও ডলারের ঘাটতি গত ৩০ বছরে আমরা দেখিনি। অনেক বিদেশি কোম্পানি ও বিমান সংস্থা তাদের মুনাফা নিজেদের দেশে নিতে পারেনি। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। এতে ব্যাংকগুলোয়ও টাকার সমস্যা হয়। তবে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।’

সমস্যা কেটে যাচ্ছে জানিয়ে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘বিদেশি ব্যাংকগুলো আবার ফিরে আসছে। তারা নতুন করে ঋণসীমা দিচ্ছে ও বাড়াচ্ছে। তবে আমাদের ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ আছে, যা আগে প্রায় বিনা সুদে নেওয়া ছিল। এখন তা ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদে পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। এটা বড় চাপ তৈরি করেছে।’

ডলার দামের পরিস্থিতি

ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা দামে প্রবাসী আয় কিনছে, আর রপ্তানি বিল কিনছে ১০৬ টাকা দামে। অর্থাৎ গড় ক্রয়মূল্য হচ্ছে ১০৭ টাকা। ফলে আমদানিতে ডলারের দাম হওয়ার কথা ১০৮ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দামে ডলার বিক্রি করছে। ফলে প্রতিনিয়ত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

তবে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অনেক ব্যাংক এখনো বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে। কারণ, বিদেশি ব্যাংকে সময়মতো দায় পরিশোধ না করলে কালো তালিকায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ফলে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি ১১০ টাকার ওপরে দাম দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল বুধবার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা দামে ডলার কেনে সিটিজেন ব্যাংক। ১০৭ টাকা ৮৫ পয়সা দরে ডলার কেনে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। অর্থাৎ গড় ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনেছে এসব ব্যাংক।

গতকাল আন্তব্যাংক ডলারের বিক্রয়মূল্য ছিল ১০৮ টাকা। মঙ্গলবার যা ছিল ১০৮ টাকা ৭৫ পয়সা।

ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ডলার পেতে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনই অনেক ক্ষেত্রে ঘোষিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যেও ডলার কিনতে হচ্ছে। কিউ পেইল প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে এক রকম ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে ডলারের দাম ভিন্ন ধরা হচ্ছে। চাহিদামতো ঋণপত্রও খোলা যাচ্ছে না।

তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের নাম উল্লেখ করে তিনি জানান, ওই ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার ১১২ টাকা দাম নিয়েছে। ‘এভাবে চলতে থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে আমরা যাব কোথায়’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

চট্টগ্রামের অন্যতম খাদ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো চাহিদামতো ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ১১৪ টাকা পর্যন্ত দাম নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। ফলে খাদ্য কেনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

Also Read: ঋণপত্র অর্ধেকে নেমেছে, কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি

সরবরাহ বাড়লেও সংকট কাটেনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ, আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমেছে মূলধনি যন্ত্রে ঋণপত্র খোলা, প্রায় ৫৬ শতাংশ। গত জুলাই-মার্চে আমদানি খরচ কমেছে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশ ও প্রবাসী আয় বেড়েছে ২ শতাংশ।

সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আমদানিতে কড়াকড়ি করার পর এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী ও রপ্তানি আয় হচ্ছে, তা দিয়ে মাসের আমদানি খরচ মিটছে। তবে ঋণ পরিশোধ ও আগের আমদানি খরচ, শিক্ষা, বিমানভাড়া, সেবাসহ নানা খরচের কারণে ডলারের সংকট রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে বেশির ভাগ ব্যাংকে ডলার ধারণের পরিমাণ ঋণাত্মক অবস্থায় ছিল। এখন সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার মজুত রয়েছে। এ ছাড়া নগদ ডলার আছে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ডলারের সরবরাহ বাড়ায় সংকট কেটে গেছে, এটা বলা যায় বলে তাঁরা মনে করেন।

তবে একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলার-সংকট পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। কারণ, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়েনি। ফলে সরবরাহ আগের মতোই আছে। অন্যদিকে পুরোনো ও নতুন আমদানি দায় এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে গেছে। ডলারের ঋণের সুদহার বাড়তে থাকায় অনেকে আগেই ঋণ পরিশোধের জন্য আসছেন। ফলে সংকট কোনোভাবেই কাটেনি।

ডলার-সংকট কাটেনি, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে।

জানা যায়, গতকাল বুধবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২ কোটি ডলার। তবে দিনে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়। ফলে রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসে।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা এখন ডলার বাজার নিয়ে আলাদা করে বক্তব্য দিতে রাজি নন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, এসব মন্তব্যের জন্য তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।

Also Read: ডলারের দর আরও বাড়াতে হবে: আহসান মনসুর

আসছে ডলারের একক দাম

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর সম্প্রতি প্রকাশিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ডলার-সংকট সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ঐতিহাসিকভাবে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের ব্যবধান ছিল ২ শতাংশের মতো। তবে ২০২২ সালের আগস্টে এই ব্যবধান ১২ শতাংশে পৌঁছে যায়। এখন এই ব্যবধান কার্যত ১৮ শতাংশে পৌঁছে যাওয়ার পর ডলারের দাম স্থিতিশীল হলেও দামের পার্থক্য খুব বেশি রয়ে গেছে।

ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের এই ব্যবধানের কারণে প্রবাসী আয় কমছে, ফলে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। সে জন্য ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দরের ব্যবধান না কমলে প্রবাসী আয় বাড়বে না। এতে ডলার-সংকটও কাটবে না বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

মার্কিন ডলারের নোট

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের এক দাম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে, যা আগামী জুন বা জুলাই থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে ডলারের একাধিক দাম থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারের দামে ডলার বেচাকেনা করবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা করলে একটা সমাধান হতে পারে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে আয় বাড়াতে হবে। তাহলে সংকটও কমবে।