Thank you for trying Sticky AMP!!

খেলাপি ঋণ কমানোর দায়িত্ব আসলে কার

ব্যাংকের এমডিরা ব্যাংক খাতের ভালো ভালো খবর তুলে ধরতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দিলেন।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেনসহ (মাঝে) অন্যরা। গতকাল ঢাকায় তেজগাঁও–গুলশান লিংক রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের। গত এক দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যাংকারদের হাত দিয়েই দেওয়া হয়েছে এসব ঋণ। সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়েই ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা এখন বলছেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাই ব্যাংক খাতের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা বলেছে। এ নিয়ে এবিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে।

তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসলে ছিল না। বরং সরকার বিভিন্ন সময় ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের নীতি নিলেও তা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তা বাস্তবায়ন করেছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকারদের দৃঢ়তা ও সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার কতটা প্রয়োজন, সে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি এবিবির সদস্যরা।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ঋণখেলাপিদের ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর হাতে পুরো ক্ষমতা থাকা উচিত। কোনো গ্রাহকের মুখ দেখে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাহলে প্রভাবশালীরা ছাড় পাবে না। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে বিচারক, বেঞ্চ বাড়ানোসহ আইনি কাঠামো জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। তাহলে খেলাপিদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় কাজ করবে।

ব্যাংক খাতের হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় এবিবির নেতারা একাধিকবার ব্যাংক খাতের ভালো ভালো খবর তুলে ধরার পরামর্শ দেন।

ঢাকায় ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন, তিন ভাইস চেয়ারম্যান—সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী ও কোষাধ্যক্ষ এবং মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি মো. আহসান-উজ জামান উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংকের এমডিদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করার ঘটনা বেশ বিরল। এর আগে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্যাংক খাতের উন্নয়ন পরিস্থিতি তুলে ধরতে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেছিল এবিবি। এরপর গত বছর ডলার-সংকটকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরতে এক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন।

 ব্যাংক খাত পুরো বিশ্বাসের ওপর চলে, সংবাদ সম্মেলনে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক কীভাবে সংকটে পড়ে গেল। সুইজারল্যান্ডেও একই ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য ব্যাংক খাতের ভালো খবরগুলো তুলে ধরার পরামর্শ দেন তিনি।

ডলার-সংকট কাটছে

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দেশের করোনা পরিস্থিতি সুন্দরভাবে মোকাবিলা করেছে সরকার। এরপর গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এই সময়ে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভও সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডলার খরচ বেড়ে যায়। ডলারের বিপরীতে গত বছর টাকার মান ২৫ শতাংশ কমে যায়, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি করে।

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘এত চাপ ও ডলারের ঘাটতি গত ৩০ বছর আমরা দেখেনি। অনেক বিদেশি কোম্পানি ও বিমান সংস্থা তাদের মুনাফা নিজেদের দেশে নিতে পারেনি। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। এতে ব্যাংকগুলোয়ও টাকার সমস্যা হয়। তবে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।’

সমস্যা কেটে যাচ্ছে জানিয়ে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘বিদেশি ব্যাংকগুলো আবার ফিরে আসছে। তারা নতুন করে ঋণসীমা দিচ্ছে ও বাড়াচ্ছে। তবে আমাদের ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ আছে, যা আগে প্রায় বিনা সুদে নেওয়া ছিল। এখন তা ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদে পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। এটা বড় চাপ তৈরি করেছে।’

ভাইস চেয়ারম্যান মাসরুর আরেফিন বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার ঋণ এলেই আর্থিক হিসাবের উন্নতি ঘটবে। সুদহারের কারণে যেসব বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে গেছে, তা ফেরত আনতে হবে। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ডলার মজুত রয়েছে। ফলে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম এখন কম।

খেলাপি ঋণ ও সংস্কার

ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে ব্যাংক খাতের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলছেন, এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সামনে ব্যাংকের জন্য যে পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধসংক্রান্ত আইনকানুন পরিপালনের শর্ত আসছে, তাতে কতগুলো ব্যাংক টিকতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।

ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকদের হস্তক্ষেপ রয়েছে, এমন অভিযোগ-সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর মালিকানা কাঠামো ভারতের মতো নয়। অনেক দেশে বাংলাদেশের মতো ব্যবসায়ী ও করপোরেট গ্রুপ ব্যাংকের মালিক হতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন কাঠামো ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। এটা দিনে দিনেই ঠিক হবে না।

শরিয়াহ ব্যাংকের সমস্যা

ফার্স্ট সিকিউরিটিসহ পাঁচ ব্যাংককে কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সহায়তা নিতে হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী বলেন, গত বছরের শেষ সময় ব্যাংক থেকে অনেক আমানতকারী টাকা তুলে নেন।

এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে গেলে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো থাকতে হয়। এর মাধ্যমে সেটা (টাকা ধার করা) সম্ভব হয়েছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের চাপ আছে কি না এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পেশাদারত্বের সঙ্গে চলছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের এমডি কি বলবে, পরিচালনা পর্ষদ চাপ প্রয়োগ করে?’