Thank you for trying Sticky AMP!!

কাজুবাদামে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’

দেশের বাজারে কাজুবাদামের মোটামুটি চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কম হওয়ায় তা আমদানি করতে হয়। আর আমদানির প্রায় পুরোটাই আসছে ভিয়েতনাম থেকে। কিন্তু প্রতিটি কাজুবাদামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার আর ডলার নিয়ে কারসাজি করার গল্প।

ভিয়েতনাম থেকে প্রকাশিত তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা করে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কারসাজির চিত্র পাওয়া গেছে। ভিয়েতনামের কাজুবাদাম রপ্তানিকারকদের সংগঠন ‘ভিয়েতনাম ক্যাশো অ্যাসোসিয়েশন’ গত ১৫ জানুয়ারি এই তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করে। এতে কোন দেশে কত দামে কাজুবাদাম রপ্তানি হয়, তা তুলে ধরা হয়। মোট ৩০ পৃষ্ঠার ওই প্রকাশনায় বিশ্বের ১০৩টি দেশে ৩২১ কোটি মার্কিন ডলারে ৫ লাখ ২১ হাজার ৪১৯ টন কাজুবাদাম রপ্তানির বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

ভিয়েতনামের প্রকাশনাটি থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে তারা গত বছর ১ হাজার ৬২৪ টন কাজুবাদাম রপ্তানি করেছে, যার দাম ৯২ লাখ ডলার। এতে প্রতি কেজির আমদানি মূল্য গড়ে ৫ দশমিক ৬৭ ডলার পড়ে, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪৮২ টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। কিন্তু বাস্তবে ভিয়েতনাম থেকে দেশে আসা কাজুবাদামের দর পাল্টে যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরে ১ হাজার ৫০৬ টন কাজুবাদাম খালাস হয়েছে। এসব কাজুবাদাম মোট ২৮ লাখ ডলারে বা প্রতি কেজি ১ দশমিক ৮৪ ডলার করে কেনার ঘোষণা দেন আমদানিকারকেরা। অথচ ভিয়েতনাম ক্যাশো অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত আমদানি মূল্য হওয়ার কথা ৮৫ লাখ ডলার। সেই হিসাবে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (কেনা দামের চেয়ে কম দাম দেখানো) মাধ্যমে গত বছর প্রায় ৫৭ লাখ ডলার অবৈধভাবে ভিয়েতনামে পাঠিয়েছেন আমদানিকারকেরা।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, কাজুবাদামে মোট শুল্ক–করের হার ৬০ শতাংশ। সে জন্য আমদানিকারকেরা শুল্ক ফাঁকি দিতে দাম কম দেখান। যে কারণে প্রতি কেজি কাজুবাদাম ১ দশমিক ৮৫ ডলার বা ১৫৭ টাকায় শুল্কায়ন করছে কাস্টমস। এতে প্রতি কেজি কাজুবাদামে শুল্ক–কর দাঁড়ায় ৯৫ টাকার কিছু কম–বেশি। আমদানিকারকেরা যদি সঠিক মূল্য অর্থাৎ প্রতি কেজি ৪৮১ টাকা দরে আমদানির ঘোষণা দেন, তাহলে শুল্ক–কর দাঁড়াত ২৮৮ টাকা। এভাবে প্রতি কেজিতে ১৯৩ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন আমদানিকারকেরা।

দেশে ২০১৬ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর এক মাসে ভিয়েতনাম থেকে ৩ হাজার ৪২০ টন কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে। সর্বশেষ প্রকৃত মূল্য হিসাব করা হলে এসব কাজুবাদাম আমদানিতে প্রায় ৬৩ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ২০২০ সালের আগে অর্থাৎ ২০১৬–১৯ সাল পর্যন্ত কাজুবাদামের প্রকৃত আমদানি মূল্য ছিল আরও বেশি। সংস্থাটির হিসাব ধরা হলে কাজুবাদামে গত পাঁচ বছরে শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ কোটি টাকা।

বাজারে নানা ব্র্যান্ডের যে টিনের কৌটায় বা প্যাকেটজাত কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো কাজুবাদাম হিসেবে আমদানির কোনো তথ্য নেই রাজস্ব বোর্ডে। অর্থাৎ শুল্ক ফাঁকি দিতে ভিন্ন কোনো পণ্যের নামে টিনের কৌটায় বা প্যাকেটজাত কাজুবাদাম আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশে কাজুবাদাম আমদানির ৯৯ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই বন্দরে খালাস হওয়া পণ্যের শুল্কায়ন করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম সম্প্রতি বলেন, ভিয়েতনামের রপ্তানি মূল্যের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে কাজুবাদাম আমদানির শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হবে। যাচাই–বাছাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কারা আমদানিকারক

গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে কাজুবাদাম আমদানি করছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারকেরা হচ্ছে ঢাকার মিরপুরের খান ট্রেডার্স অ্যান্ড মার্কেটিং; লালবাগের জেনারেল ট্রেডিং কোং, এম রহমান, ইনায়া করপোরেশন, হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদার্স; মৌলভীবাজারের মজুমদার ট্রেডিং; চকবাজারের দিগন্ত এন্টারপ্রাইজ; চট্টগ্রামের গুলিস্তান ট্রেডিং, সাউদার্ন কমার্শিয়াল ইত্যাদি।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ভিয়েতনামের সবচেয়ে ভালো মানের কাজুবাদাম দেশে আমদানি হয় না। তাঁরা যে দরের ঘোষণা দিয়েছেন, সেই দামেই আমদানি করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।

আমদানিকারকদের মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে একটি প্রতিষ্ঠানকে, যেটি কারসাজি করেনি। সেই প্রতিষ্ঠানটি হলো সিলেটের হবিগঞ্জের অ্যাগ্রো লিমিটেড। এটি প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তারা প্রতি কেজি সাড়ে ছয় ডলার বা ৫৫২ টাকায় আমদানি করেছে, যা ভিয়েতনামের তথ্যের সঙ্গে মিলে গেছে। শুল্ক–করও ঠিকভাবে দিয়েছে।

হতাশ উদ্যোক্তারা

গত কয়েক বছরে দেশে কাজুবাদামের কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। তারা আমদানিকারকদের কারসাজির কারণে পেরে উঠছে না।

কাজুবাদামের প্রথম সমন্বিত কারখানা গ্রিনগ্রেইন কেশিও প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিতে যেটি হচ্ছে, তা পুরোপুরি কারসাজি। এটি বন্ধ করা সম্ভব হলে দেশীয় কাজুবাদাম প্রস্তুতকারক কারখানাগুলো দেশের চাহিদা মেটাতে পারবে, আবার রপ্তানিও করতে পারবে।

নীলফামারীর জ্যাকপট ক্যাশোনাট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল আরিফুজ্জামান বলেন, দেশীয় কারখানাগুলোতে প্রতি কেজি কাজুবাদাম প্রস্তুত করতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে আমদানি করা কাজুবাদাম। কারসাজির কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে।