Thank you for trying Sticky AMP!!

চীনের ঋণের গড় সুদহার বেশি, মেয়াদও কম

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক এই দুরবস্থার পেছনে চীনের ভূমিকা কতটা, তা নিয়ে এখন জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। শ্রীলঙ্কার সরকারি সূত্রানুসারে, শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে চীন থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। সেই অর্থে শ্রীলঙ্কার এই সংকটের পেছনে চীনা ঋণের ভূমিকা খুব একটা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই সংকটে চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজাপক্ষে সরকারের প্রতি চীনের শীতল আচরণ অনেক দেশের জন্য চিন্তার খোরাক হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি এশিয়ান নিক্কি পত্রিকায় শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সেখানে শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে পাঁচটি বিষয় বোঝা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কান অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা কী

সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে দুই মেয়াদে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকার দ্বিতীয় মেয়াদে শ্রীলঙ্কা চীনের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়ে। তখন তামিলদের সঙ্গে দীর্ঘ ৩০ বছরের যুদ্ধ কেবলই শেষ হয়েছে। দরকার ছিল প্রচুর পরিমাণ অর্থের। সেই সময় ৫০০ কোটি ডলারের চীনা ঋণের সুবাদে শ্রীলঙ্কার অবকাঠামো উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগে। নতুন এসব অবকাঠামোর বড় একটি অংশ ছিল রাজাপক্ষেদের জন্মস্থান দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায়। সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, মহাসড়ক—কী ছিল না সেখানে।
অন্যদিকে তামিলবিরোধী যুদ্ধের শেষ দিকে অস্ত্রের জন্য শ্রীলঙ্কা চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ওই সময়  শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ১৮০ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনে।

আবার চীনের ঋণের সঙ্গে স্বচ্ছতা ও সুশাসনজনিত শর্তের বেড়াজাল অতটা কঠোর নয়, সে কারণে জাপানি ঋণের চেয়ে শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। জাপান শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী। কিন্তু বর্তমানে শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে জাপান ও চীন থেকে নেওয়ার পরিমাণ সমান—১০ শতাংশ।

এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার কলম্বো উপকূলের অদূরে চীন ১৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ব্যবসায়িক কেন্দ্র নির্মাণের কাজও করছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এর মধ্য দিয়ে চীন ভারত মহাসাগরে কৌশলগতভাবে ভারতের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে।

চীনের ঋণ ও অন্যদের ঋণ

২০২০ সালের মধ্যেই এই শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে যে শ্রীলঙ্কা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবে। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন দেশটির সরকারের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক—৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ।

আগেও বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীন থেকে নেওয়া। কিন্তু ঋণের সুদহারের কারণে চীন অন্যদের চেয়ে আলাদা। কলম্বোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেরিট রিসার্চের এক হিসাবে দেখা গেছে, চীনের ঋণের গড় সুদহার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে জাপানের ঋণের গড় সুদহার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। আর চীনের ঋণের মেয়াদ যেখানে ১৮ বছর, সেখানে ভারতের ঋণের ২৪ বছর আর জাপানের ঋণের ৩৪ বছর।

কিন্তু এত সব সত্ত্বেও রাজাপক্ষে পরিবার চীনের ঋণ নেওয়া থেকে বিরত হয়নি। তামিলদের কচুকাটা করার পর শ্রীলঙ্কা সরকার ৩১৩টি ঋণভিত্তিক প্রকল্পের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই করেছে চীনের ঋণ নিয়ে।

চীন শ্রীলঙ্কার ইচ্ছাপূরণের ব্যাংক হয়ে ওঠে

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক কাঠামোতে অনেক গভীর ঢুকে গেছে চীন। ফলে মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিদায়ের পর ২০১৮ সালে দেশটিতে যখন ভারত ও পশ্চিমপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখনো তারা আইএমএফকে বাদ দিয়ে চীনের ঋণ নেয়। চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা ১০০ কোটি ডলারের সিন্ডিকেট ঋণ নেয়। অথচ এই ঋণের সুদহার ছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মেয়াদ ছিল মাত্র ৮ বছর।
এরপর চীন আরও বড় টোপ দিয়ে বসে। তারা শ্রীলঙ্কার ১০০ কোটি ডলারের সার্বভৌম ঋণ কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেবার শ্রীলঙ্কা তা গ্রহণ করেনি। চীনের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে সেবার তারা আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজার থেকে সেই ঋণ নেয়।

তবে কোভিডের প্রভাবে আবারও রাজাপক্ষেরা ক্ষমতায় এলে ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। মহামারির ধাক্কা মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে যে ১০০ কোটি ডলার চেয়েছিল, তার অংশ হিসেবে এই ঋণ নেয় তারা। তবে দ্বিতীয় পর্বে এই ঋণের মেয়াদ ছিল ১০ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ছিল ৩ বছর।

সংকটের সময় বেইজিংয়ের ভূমিকা

এ বছর শ্রীলঙ্কার ৬৯০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করার কথা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও সম্প্রতি পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে বেইজিংয়ের কাছে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন জানান। কিন্তু চীনাপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও চীন খুব কোমল আচরণ করেনি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। ফলে এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কা ঋণ খেলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হয়। এই ঘটনা শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত কি ঝেনহং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, চীন শ্রীলঙ্কার জন্য সাধ্যের মধ্যে সবই করেছে, যাতে তাদের ঋণ খেলাপ করতে না হয়; কিন্তু তারা খেলাপ তো করলই, সেই সঙ্গে আবার আইএমএফের কাছে গেল।

এমনকি অন্যান্য ঋণদাতা যখন শ্রীলঙ্কাকে এই সংকট মোকাবিলায় নতুন ঋণ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে, তখনো চীন খুব উষ্ণ আচরণ করেনি। কয়েক মাস ধরে চীন ও শ্রীলঙ্কা অবশ্য ১৫০ কোটি ডলারের ক্রেডিট লাইন ও ১০০ কোটি ডলারের সিন্ডিকেট ঋণ নিয়ে আলোচনা করছে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ঋণদাতাকে একই পাল্লায় মাপতে চায়, কিন্তু চীনের বর্তমান অবস্থান শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পরিকল্পনার জন্য হুমকিস্বরূপ।

অন্যান্য দেশের কী অবস্থা

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের এই আচরণের পর এবার অন্যান্য দেশও ভাবতে শুরু করেছে, একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে চীন তাদের সঙ্গে কী করবে। চীনের কাছে ঋণগ্রস্ত কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, মালদ্বীপ ও নেপালের সরকারি কর্মকর্তারা তাই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।