Thank you for trying Sticky AMP!!

ভ্যান বিক্রি করে ঘরভাড়া দিতে হয় ফজলু মিঞাকে

  • শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ১৮.৯ এবং ২০১৮ সালে ১৬.৩ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ।

  • নগর দারিদ্র্য বহুমুখী।

  • বাসস্থান, সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা—এসব চাহিদা মেটাতে নগর দরিদ্রদের হিমশিম খেতে হয়।

রাজধানীর মধুবাগে আসবাব আনা-নেওয়ার কাজ করেন ফজলু মিঞা। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ভালোই চলছিল সব। দিনে উপার্জন হতো প্রায় হাজার টাকা। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে তাঁর আয় কমে ২০০-৩০০ টাকায় নেমে এসেছিল, যদিও এখন তা ৫০০-৬০০ টাকায় উঠেছে।

স্ত্রী-সন্তানকে গত বছর সাধারণ ছুটির সময়ই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফজলু মিঞা। এখনো তারা বাড়িতেই। কিন্তু বাড়িভাড়ার হাত থেকে রেহাই নেই। সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়া দিতে তিনি এখন হিমশিম খান। বাড়িওয়ালাকে তিন মাসের বকেয়া ভাড়া ভেঙে ভেঙে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা রাজি না হওয়ায় শেষমেশ উপার্জনের একমাত্র সম্বল ভ্যানগাড়িটি বিক্রি করে বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করেছিলেন। অবশ্য পরে আবার একটি ভ্যানগাড়ি কিনেছেন।

মধুবাগ মাঠের সামনে সন্ধ্যায় ভেলপুরি বিক্রি করেন মো. আরজু। সকালে বিক্রি করেন পার্শ্ববর্তী একটি স্কুলের সামনে। কোভিডের আগে দিনে দুই বেলায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি হতো তাঁর। তাতে হাজার-বারো শ টাকার মতো লাভ হতো। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর দৃশ্যপট বদলে যায়। গ্রামে চলে যান। ঢাকায় থাকেন বলে গ্রামের নেতারা সরকারি ত্রাণ দিতে গড়িমসি করেন। বলা বাহুল্য, এ সময় জমা টাকা খরচ করতে হয়েছে। তাই সে পথে আর হাঁটেননি। আড়াই মাস গ্রামে কাটিয়ে গত বছর ঈদুল ফিতরের পর আবার ঢাকায় ফেরেন তিনি। এখন সারা দিন অনেক চেষ্টা করে ৩০০-৪০০ টাকার মতো থাকছে। কিন্তু ঘরভাড়া তো কমেনি। অন্যান্য খরচও হয় আগের মতো, নয়তো বেড়েছে।

বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে নগরের খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমেছিল ৮০ শতাংশ। সে তুলনায় গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষ তুলনামূলকভাবে ভালো আছেন, তাঁদের আয় কমেছে ২০ শতাংশ।

বেতন বা মজুরির বিনিময়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিক বলেছেন, ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে তাঁদের মজুরি বা বেতন ২০১৯ সালের তুলনায় কমেছে। আর এ সময়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমিক-কর্মী কাজ হারিয়েছেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি কাজ হারিয়েছেন। কর্মসংস্থান ও অভিবাসনে কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিরূপণে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এর আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে নগরের খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমেছিল ৮০ শতাংশ। সে তুলনায় গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষ তুলনামূলকভাবে ভালো আছেন, তাঁদের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে দেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে বলে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জানায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ অনুসারে ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে, এ হার ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। করোনার কারণে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

ফজলু মিঞা এখন প্রায় সারা দিনই মধুবাগ পুলিশ ফাঁড়ির পাশে বসে থাকেন কাজ পাওয়ার অপেক্ষায়, অথচ আগে তাঁকে খুঁজে পাওয়াই ছিল ভার। দিনের বেশির ভাগ সময়ই ভ্যানের ওপর পা ছড়িয়ে বসে থাকেন, নাহয় সহকর্মীদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, তাস-লুডু খেলেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে হলে একদিকে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও প্রণোদনার অর্থের সঠিক বণ্টনে গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক

এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এতে যাঁদের আয় কমেছে, তাঁদের অবস্থা আরও করুণ। স্বাভাবিকভাবে খাবার খরচ কমিয়ে দিয়েছেন ফজলু মিঞার মতো মানুষেরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে হলে একদিকে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও প্রণোদনার অর্থের সঠিক বণ্টনে গুরুত্ব দিতে হবে। সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শক্তিশালী মূল্য কমিশন গঠন করা অত্যন্ত জরুরি এবং এই কমিশনে যাতে ভোক্তা, উৎপাদক, গবেষক ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অংশগ্রহণ থাকে, তা নিশ্চিত করা দরকার বলে তাঁর মত। এই কমিশন একদিকে গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের চাহিদা, জোগান, ভবিষ্যতের প্রাক্কলন, আমদানি ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করবে, অন্যদিকে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বিকল্প আমদানির উৎস নিয়ে গবেষণা করবে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, নগর দারিদ্র্য বহুমুখী। বাসস্থান, সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা—এসব চাহিদা মেটাতে নগর দরিদ্রদের হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তাঁদের লক্ষ্য করে প্রণয়ন করা হয় না। আবার তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসার সমস্যা হলো তাঁরা সাধারণত এক জায়গায় থাকেন না। কে কোথায় থাকেন, সেই হিসাবও রাখা হয় না। ভারতের আধার কার্ডের মতো সমন্বিত ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যা দূর করা যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।