Thank you for trying Sticky AMP!!

মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে চলছে লুকোচুরি

বিবিএসের খসড়া হিসাবে গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে।

মূল্যস্ফীতি

মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে চলছে লুকোচুরি। সেপ্টেম্বর মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ সরকার আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি। বেশি হারে বেড়েছে বলেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে একধরনের রাজনীতি করা হচ্ছে।

সাধারণত প্রথম সপ্তাহেই আগের মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এবারও তা-ই করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো সরকারের উচ্চপর্যায়ের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়া যায়নি। ফলে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করছে না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বিবিএসের খসড়া হিসাবে গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে। এক মাসের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির তথ্য সরকার প্রকাশ না করলেও সীমিত আয়ের মানুষ ঠিকই এর উত্তাপ পাচ্ছে।

যখন মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে দেরি হয়, তখন সরকারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হওয়া উচিত।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। প্রতিনিয়ত চাপ সামলাতে হচ্ছে তাদের। এতে গরিব আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে, মধ্যবিত্তরাও জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অবশ্য আশ্বস্ত করে বলেছেন, শিগগিরই আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হবে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। তবে সেই শিগগিরই কবে আসবে, তা তিনি বলেননি।

এ নিয়ে প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপীই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে শুরু করবে মূল্যস্ফীতির চাপ। তিনি জানান, মূল্যস্ফীতির একটি বার্ষিক চক্র আছে। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে। কারণ, এই সময়ে বৃষ্টিবাদল, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল উৎপাদন কম থাকে। আর নভেম্বর থেকে এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার কম থাকে।

কেন এত আলোচনা

এবার আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ আগ্রহ আছে। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

কয়েক মাস ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। আবার তখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কিছুটা কমেছিল। ঠিক এ রকম এক সময়ে, গত ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা ও পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানো হয়নি।

Also Read: সরকার ডেকে আনল মূল্যস্ফীতি

এর পরপরই সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। এরপর গত ২৯ আগস্ট খানিকটা মুখ রক্ষা করতে জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমায় সরকার।

তবে তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি; বরং এর সামগ্রিক প্রভাবে খাদ্যপণ্য ছাড়াও যাতায়াত, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রীসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেশ বেড়ে যায়। সুতরাং তখন থেকেই আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির শঙ্কা করা হচ্ছিল। একাধিক অর্থনীতিবিদের প্রাক্কলন ছিল, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যখন মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে দেরি হয়, তখন সরকারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাধারণত প্রথম সপ্তাহেই মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি হয়ে যায়। তাহলে এখনো দিচ্ছে না কেন? তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হওয়া উচিত।

কারণ, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নীতি ঠিক করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে, তথ্য ঢেকে রাখা হচ্ছে। ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যা-ই হোক না কেন, এটা প্রকাশ করা উচিত। বিভিন্ন দেশ তাদের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে ফেলছে। তাঁর মতে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরও ৩ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

আহসান এইচ মনসুর

কমলে প্রথম সপ্তাহে, বাড়লেই বিলম্ব

গত কয়েক মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের সময়কাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো মাসের মূল্যস্ফীতি কমলে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই তা প্রকাশ করা হয়। আবার বাড়লে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে পরের মাসের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

যেমন গত মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি ছিল। যেমন মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং জুন মাসে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওই দুই মাসের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় পরের মাসের ১৯ তারিখ। আবার গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়। আর জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতির সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় দ্রুতগতিতে, আগস্ট মাসের ৩ তারিখে।

দেশের প্রায় সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করার একমাত্র সংস্থা বিবিএস। ৮-৯ বছর আগে বিবিএস আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করত। বিবিএসের পরিবর্তে এখন পরিকল্পনামন্ত্রী নিজে মূল্যস্ফীতির তথ্য সাংবাদিকদের জানান। মূলত বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালই পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নিজেই মূল্যস্ফীতির তথ্য সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে শুরু করেছিলেন।

আবার ২০১৭ সালে মূল্যস্ফীতি টানা বাড়তে থাকলে আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রতি মাসের পরিবর্তে তিন মাস পরপর মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে আবারও মাসিক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ শুরু হয়েছিল।

Also Read: মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন চিন্তিত নয়

এক নম্বর সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি

মূল্যস্ফীতি এখন সারা বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাপী সব ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নেওয়া হচ্ছে মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড মূল্যস্ফীতি কমাতে আগ্রাসীভাবে নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে মন্দাকে পর্যন্ত ডেকে আনা হচ্ছে।

এ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী চলছে প্রবল বিতর্ক। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সবাই যদি সমন্বিতভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি না করে, তাহলে মন্দার চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে। দেখা দিতে পারে স্ট্যাগফ্লেশন বা বদ্ধস্ফীতি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আদৌ কমল না, অথচ প্রবৃদ্ধি কমে গেল ভয়াবহভাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিলিনা জর্জিয়েভা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি, তাদের রক্ষা করা না গেলে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৪ সালে মূল্যস্ফীতিকে বলেছিলেন জনগণের এক নম্বর শত্রু (পাবলিক এনিমি নম্বর ওয়ান)।

বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল গত ফেব্রুয়ারি থেকেই। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে জুন মাসে তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়ায়। গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল এই জুন মাসেই। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল।

Also Read: অর্থনীতির মূল্যস্ফীতি বনাম মন্ত্রীদের শব্দস্ফীতি

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। অনেকে তাকে নীরব ঘাতকও বলেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এ রকম এক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়েই দায় সারছে। অথচ বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে মুদ্রানীতির প্রয়োগ, মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশ নিচ্ছে না। ফলে কমছে না মূল্যস্ফীতি, বরং রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির তথ্য দিয়ে নীতি ঠিক করা দরকার। মূল্যস্ফীতির তথ্য না থাকলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব কীভাবে। আমানত ও ঋণের সুদের হার মূল্যস্ফীতি দিয়ে ঠিক করা উচিত। মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতেও মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য দরকার।’