Thank you for trying Sticky AMP!!

ডলার–সংকটে আর্থিক হিসাবে সর্বোচ্চ ঘাটতি

২০০৯-১০ অর্থবছরের পর এবারেই প্রথম আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আর এবারের ঘাটতি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

ডলার–সংকটে দেশের আর্থিক হিসাব পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। এতেই আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি। গত এক যুগের মধ্যে এটাই প্রথম ও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি। মূলত একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওঠানামা নির্ভর করে এই আর্থিক হিসাবের ওপর। এই ঘাটতির কারণেই রিজার্ভও ক্রমাগত কমছে।

দেশে এখন প্রবাসী আয়ের পুরোটাই এখন দিনে দিনে দেশে চলে আসে। রপ্তানি যা হয়, তার বড় অংশ খরচ হয়ে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। আবার সব রপ্তানি আয় সময়মতো দেশেও আসে না। এর বাইরে দেশে ডলার আয়ের অন্যতম মাধ্যম বিদেশি ঋণ, অনুদান ও বৈদেশিক বিনিয়োগ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন (বায়ার্স ক্রেডিট)। দেশি ব্যাংকগুলোও বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণসীমা নিতেন। এর সবই এখন কমতির দিকে।

বরং ডলারের দাম বাড়তে থাকায় উল্টো বিদেশি ঋণ শোধ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এতেই দেশে ডলারের প্রবাহ কমে গেছে এবং আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ কমছে না, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও থামানো যাচ্ছে না। এতকিছুর পরেও ডলারের দাম এখনো ব্যাংকগুলো আটকে রেখেছে। এই দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কেউ তা বলতে পারছে না।

আর্থিক হিসাবে এভাবে ঘাটতি তৈরির ঘটনা অনেক দিন দেশে ঘটেনি। উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক হিসাব ভালো রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে দেশের রেটিং ভালো থাকে।
আহসান এইচ মনসুর, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক
ডলার

ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এখন ১০৮ টাকা হলেও আমদানিতে ১১৩ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। আর রিজার্ভ কমে হয়েছে ২ হাজার ৯৭৭ কোটি ডলার, যা এক বছর আগেও ছিল ৪ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক হিসাব ভালো রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এর ওপরই একটি দেশের ঋণমান নির্ভর করে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি দুই অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত এক দশকে আর্থিক হিসাবে কখনো ঘাটতি হয়নি, এখন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য হচ্ছে, এই আর্থিক হিসাব ভালো করা। আজ বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দেবে। এই মুদ্রানীতিতে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমানোর কথা থাকবে।

Also Read: ডলার সংকট থেকে মুক্তি মিলছে না কেন

এক যুগ পর যেভাবে ঘাটতি

বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় থেকে দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয়। এর মধ্যে থাকে সরাসরি বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইক্যুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের প্রথম বছরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সব৴শেষ আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তখন ঘাটতি ছিল ৬৩ কোটি ডলার। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ঘাটতি ২১৬ কোটি ডলার। এক যুগ আগেও ঘাটতি দেখা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। এবারের ঘাটতিও একই কারণে। তবে এ সময়ের মধ্যে ডলারের দর ধরে রাখার কারণে এবারের সংকট বেশি প্রকট হচ্ছে।

Also Read: ডলার ব্যবসা করে ব্যাংক খাত সবচেয়ে ভালো আছে

এত ঘাটতি কেন

ডলারের দাম সামনে আরও বেড়ে যাবে—এই আশঙ্কায় দেশি উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। উল্টো আগের ঋণ শোধ করা বাড়িয়েছেন। এমনকি খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মেয়াদ বাকি রয়েছে, এমন ঋণও শোধ করে দিচ্ছেন। এর ফলে গত দেড় বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাঠাতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত মার্চে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল ২ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার (২৪.৯৮ বিলিয়ন), যা গত বছর শেষে কমে হয়েছে দুই হাজার ৪৩০ কোটি ডলার (২৪.৩০ বিলিয়ন)। তবে সরকারি খাতে ঋণ ৬ হাজার ৮২৫ কোটি ডলার (৬৮.২৮ বিলিয়ন) থেকে বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ১৯৩ কোটি ডলার (৭১.৯৩ বিলিয়ন)। ফলে বিদেশি ঋণ ৯৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬ বিলিয়ন ডলার।

উদ্যোক্তারা মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান (বায়ার্স ক্রেডিট) ঋণ নিতেন, ডলারের দাম বাড়ায় তা–ও নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার বিলম্বে পরিশোধ সুবিধা (ডেফার্ড পেমেন্ট), ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র সবই কমে গেছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদি ঋণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৭২ কোটি ডলার।

এদিকে পণ্য রপ্তানি করার পরেও তার অর্থ বিদেশে বেশি সময় আটকে থাকছে। যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার অর্থ দেশে আসতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। এর ফলে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৩৬০ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বিদেশে আটকে থাকা রপ্তানি পণ্যের মূল্য ১৩২ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।

দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি ব্যাংক থেকে যে ঋণ ও ঋণসীমা নিত, তা–ও কমে এসেছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত যাতে ঘাটতি হয়েছে ২৭৬ কোটি ডলার। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের বাজার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে খারাপ বার্তা গেছে। এর ফলে ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক। আবার রপ্তানি আয় আসার গতিও কমে গেছে। প্রবাসী আয়ও বেশি দাম দিয়ে দেশে আনা যাচ্ছে না। এসব কারণেই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি হয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ীরা এখনো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। ডলারের দাম বেড়ে খাদ্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে।

ঘাটতি কমবে কবে

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আশা করছে, বাজেট সহায়তা ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ এলে আর্থিক হিসাবে উন্নতি হবে। তখন ঘাটতি থাকবে না। সুতরাং বড় ভরসা এখন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থার প্রতিশ্রুত ঋণের ছাড়।

বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, বেসরকারি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তাতে সাময়িক অস্বস্তি তৈরি হলেও ভবিষ্যতের জন্য ভালো। কেননা, ভবিষ্যতে ডলার ঋণ পরিশোধে চাপ কম থাকবে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ডলারের হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার পাশাপাশি নীতিমালায় যেসব শিথিলতা আরোপ করা হয়েছে, তা তুলে দিতে হবে। এতে বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা আবার ফিরে আসবে। এ ছাড়া ডলারের বাজার স্বাভাবিক হবে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক হিসাবে এভাবে ঘাটতি তৈরির ঘটনা অনেক দিন দেশে ঘটেনি। উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক হিসাব ভালো রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে দেশের রেটিং ভালো থাকে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ঋণ করে হলেও এই হিসাব ভালো রাখাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়াটা খারাপ কিছু না। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ও রেটিং ভালো থাকে। এতে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিয়মের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে চলতে দিলে সংকট অনেকটা কেটে যেত। সেটিই করা হচ্ছে না। এক বছর পেরিয়ে গেল। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে ঠিকই মানুষ চাপে পড়ল।