Thank you for trying Sticky AMP!!

তিন তরুণের শাটেল মেলা

শাটেলের সেবা নিচ্ছেন দুই তরুণী

ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) পড়াশোনার সময় দুই তরুণ রিয়াসাত চৌধুরী ও জাওয়াদ জাহাঙ্গীর এমন একটি নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করেন, যেটি হবে সমাজে বিদ্যমান কোনো সমস্যার সমাধানকেন্দ্রিক। বেশ কিছু ভাবনার মধ্য থেকে অবশেষে ঢাকা শহরের গণপরিবহন নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এ চিন্তা থেকেই পরবর্তী সময়ে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাপভিত্তিক নিরাপদ পরিবহনসেবার প্রতিষ্ঠান ‘শাটেল’।

২০১৮ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ঢাকা শহরে ৭০টির বেশি রুট বা পথপ্রতিদিন গড়ে দুই হাজার লোককে সেবা দিচ্ছে। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে তারা। ফল হিসেবে মিলেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বীকৃতি।

শাটেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিয়াসাত চৌধুরী। ২০১২ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই বিভিন্ন সংগঠন করার সুবাদে পরিচয় হয় শাটেলের অপর সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। দুজন বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়ে ভাবতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা ঢাকা শহরের গণপরিবহন নিয়ে কাজের চিন্তা করেন। তবে চিন্তা থাকলেও তখন উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁদের।

উচ্চশিক্ষা শেষে ২০১৬ সালে টেলিকম কোম্পানি রবিতে চাকরি নেন রিয়াসাত। পরের বছর সৃজনশীল কর্মীদের জন্য ‘আর ভেঞ্চারস’ নামে রবি একটি বিশেষ বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমেই নিজের চিন্তা বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যান রিয়াসাত। এ কাজে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন শাটেলের অপর দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ জাহাঙ্গীর ও শাহ সুফিয়ান।

রিয়াসাত বলেন, ‘রবি আমাদের নগরের পরিবহন খাত নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাটি পছন্দ করে। ফলে রবি থেকে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ পেয়ে “ইজি ট্রান্সপোর্ট” নামে আমরা প্রথম যাত্রা শুরু করি।’

সারা দেশেই, বিশেষ করে ঢাকা শহরে গণপরিবহনে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে তো এ দুর্ভোগ সীমাহীন। তাই ঢাকার বাসসেবা খাতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা ও অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন টিকেটিংসহ বেশ কিছু সংস্কার আনা ছিল রিয়াসাতদের লক্ষ্য।

কাজে নেমে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন তাঁরা। কারণ, বাসমালিকেরা এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তাঁরা সহযোগিতাও করতে চাননি। এ ছাড়া এই খাতে সংস্কারের জন্য অনেক সরকারি অনুমোদন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। এসব জটিলতার কারণে বাসের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে মাইক্রোবাসের মাধ্যমে বিকল্প একটা পরিবহনব্যবস্থা চালুর চিন্তা করেন এই তিন উদ্যোক্তা।

রিয়াসাত জানান, ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন—এমন ৭০০ জনের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধানের চিন্তা করেন তাঁরা। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের জুনে নারীদের জন্য প্রথম পরিবহনসেবা শুরু করেন তাঁরা। সেবার নাম দেন ‘শাটেল’। এক বছরেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেবাটি। তবে এর অধিকাংশ গ্রাহক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

পরের বছর অক্টোবরে করপোরেট সেবা চালু করে শাটেল। কিন্তু করোনা মহামারির প্রভাব শুরু হলে নারীদের জন্য সেবাটি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। তবে ওই সময় করপোরেট সেবাটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। করোনার বিধিনিষেধকালে এ সেবায় ১০০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়।

২০২১ সালের শুরুতে সরকার বিধিনিষেধ তুলে নিলে নারীদের জন্য সেবাটি পুনরায় চালু করে শাটেল। একই সঙ্গে চালু করে একটি ‘ইউনিসেক্স সেবা’। অর্থাৎ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই এ সেবা চালু করা হয়। বর্তমানে শাটেল ব্র্যান্ডের অধীনে ওমেন অনলি, করপোরেট সেবা ও ইউনিসেক্স সেবা—তিনটিই চালু আছে।

শাটেলের প্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ জাহাঙ্গীর, রিয়াসাত চৌধুরী ও শাহ সুফিয়ান

১ কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে শুরু করা শাটেলের বর্তমানে মোট বিনিয়োগ ১৫ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৪ কোটি টাকার মতো। বর্তমানে শাটেলে ৮০ জন নিয়মিত কর্মী কাজ করেন। আর প্রতিবছর ব্যবসায় ৫০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

রিয়াসাত জানান, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ ৭০টির বেশি পথে আছে শাটেলের সেবা। করপোরেট অফিসের কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাটেলের সেবা বেশি নেন। অ্যাপসে নিবন্ধনের পরে কেউ চাইলে প্রতি রাইডের জন্য কিংবা পুরো মাসের প্যাকেজে সেবাটি নিতে পারেন। দেশে প্রচলিত রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোর তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম ভাড়া নেয় শাটেল।

দেশে সম্প্রতি জ্বালানির দাম বেড়েছে। এতে পরিবহন খরচ কমাতে অনেকে শাটেলের সেবা নিচ্ছেন। ফলে গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে বলে জানান এর সিইও রিয়াসাত।

তবে এ উদ্যোগের শুরুতে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করাটা বেশ কঠিন ছিল বলে জানান রিয়াসাত। তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সহায়তা নিই। ফেসবুকে শাটেলের জন্য একটা গ্রুপ খুলি। সেখানে ব্যবহারকারীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা লিখতেন। সেটা দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হতেন। এভাবে ধীরে ধীরে সবার আস্থা অর্জন করি আমরা।’

শাটেল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, তা জানতে চাইলে রিয়াসাত জানান, নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাওয়া গেলেও অধিকাংশের অফিস থেকে বের হওয়ার সময় কিন্তু ভিন্ন হয়। এ জন্য শাটেলের পরিসর এমনভাবে বাড়াতে চান যেন পিক আওয়ারে প্রতি ১৫ মিনিট পরপর গ্রাহকেরা শাটেলের গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া ২০২৪ সালের মধ্যে সেবাটি দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন তাঁরা।

তবে এত সেবা দিলেও শাটেলের নিজস্ব কোনো পরিবহন নেই। অন্য মালিকদের থেকে চুক্তিভিত্তিক মাসিক ভাড়ায় মাইক্রো ও চালক নেয় শাটেল। এ রকম প্রায় আড়াই শ গাড়ি আছে শাটেলের।

নিরাপদ পরিবহনসেবার জন্য শাটেল ও এর উদ্যোক্তারা পেয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। চলতি বছরে ‘ফোর্বস ৩০ আন্ডার ৩০ এশিয়া ২০২২’ শীর্ষক তালিকায় স্থান পেয়েছেন শাটেলের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ জাহাঙ্গীর ও রিয়াসাত চৌধুরী। ২০১৯ সালে ইনক্লুশন অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস বিভাগে বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে শাটেল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিকস অ্যান্ড সাপোর্ট প্রতিষ্ঠান থেকে মিলেছে ইয়ং অ্যাচিভার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার।

নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি রিয়াসাতের পরামর্শ, সব সময় গ্রাহকের প্রয়োজন অনুসারে বড় সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে হবে। সমস্যার সমাধান গ্রাহকেরাই বলে দেবেন। বাজারে প্রয়োজন না থাকলে সে উদ্যোগ–পরিকল্পনা সফল না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ ছাড়া পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। রিয়াসাত বলেন, ‘আমরা বাসসেবা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেটা সফল হচ্ছে না দেখে বসে থাকলে আজকের এ অবস্থানে আসতে পারতাম না।’