Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে ডলার

নিত্যপণ্য, কাঁচামাল, শিল্পের সরঞ্জাম—সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল না হওয়া নিয়ে এখনো উদ্বেগ।

বিশ্ববাজারে গত মে মাসে চিনির যে দর ছিল, তার চেয়ে এখন কম। বিপরীতে দেশের বাজারে মে মাসের তুলনায় এখন চিনির দর কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে সায় দিয়েছে।

মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী সূত্র জানিয়েছে, এবার ব্যয় বিশ্লেষণে চিনির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে মার্কিন ডলারের দাম। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) ডলারের দাম ধরেছে ১০৫ টাকা। আগের দফায় ধরা হয়েছিল ৯৫ টাকা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চিনির দর বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে গত মে মাস থেকে। ওই মাসে ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা, এখন সেটা ১০৬ টাকায় উঠেছে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মে মাসের তুলনায় এখন শুধু ডলারের দামের কারণে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৩০, পাম তেলে ২০, প্রতি কেজি মসুর ডালে ১৮, চালে ৭ ও গমে ৮ টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। মানে হলো, ডলারের দাম যদি মে মাসের সমান থাকত, তাহলে এখন লিটারপ্রতি সয়াবিন তেল ৩০ টাকা কমে আমদানি করা যেত।

Also Read: ডলার–সংকটের মধ্যে কমল প্রবাসী আয়ও

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। সমস্যা তখনই হয়, যখন হঠাৎ করে ব্যাপক ওঠানামা হয়। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো মুদ্রার মানের দ্রুত উত্থান-পতন নিয়ন্ত্রণে রাখা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কাজটি করতে পারেনি। যখন চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন রপ্তানিকারক দেশ নিয়মিত তাদের মুদ্রার মানে ছাড় দিয়ে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়িয়েছে, তখন বাংলাদেশ টাকার মান ধরে রেখেছে। কিন্তু যখন সংকটজনক একটি পরিস্থিতি এল, তখন ডলারের দাম লাগামছাড়া হলো।

আহসান এইচ মনসুর

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত দুই বছরে ডলারের দামে তেমন হেরফের হয়নি, ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে। বলা যায়, গত মে মাসের শুরু পর্যন্ত ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। এরপর থেকে দাম বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। এখন যে দরটি আছে, তা–ও নিয়ন্ত্রিত।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা ছিল সাংঘাতিক ভুল। আমরা ধীরে ধীরে মূল্য সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ছিল অনমনীয়। এরপর হঠাৎ করে অনেকটা বেড়ে গেল।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে লাফিয়ে ডলারের দাম প্রায় ২২ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় সব পণ্যের আমদানি খরচ বেড়েছে। বিশ্ববাজারেও দাম চড়া। ফলে মানুষকে একসঙ্গে দুটি ধাক্কার মুখে পড়তে হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার উঠে গেছে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যস্ফীতির হিসাবটিই প্রকাশ করা হচ্ছে না।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা ছিল সাংঘাতিক ভুল। আমরা ধীরে ধীরে মূল্য সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ছিল অনমনীয়। এরপর হঠাৎ করে অনেকটা বেড়ে গেল।’

Also Read: ডলারে কার লাভ, কার ক্ষতি

এক মাসে ১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা

দেশে গত মাসে যে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে, গড়ে তার দাম পড়েছে টনপ্রতি ১ হাজার ৭১০ ডলার। ডলারপ্রতি দর ৮৭ টাকা ধরে কেজিপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ১৪৯ টাকা। আর ডলারপ্রতি ১০৬ টাকা ধরে দাম দাঁড়ায় ১৮১ টাকা। ফলে কেজিতে বাড়তি পড়ছে ৩৩ টাকা, যা লিটারে দাঁড়ায় ৩০ টাকার মতো।

ভোজ্যতেল, গম, চিনি, চাল, ডাল ও গুঁড়া দুধ—গত মাসে বেসরকারি খাতে এ ছয় পণ্য আমদানি হয়েছে ৯ লাখ টনের কিছু বেশি। আমদানি মূল্য প্রায় সাড়ে ৬৪ কোটি ডলার। গত মে মাস ও সেপ্টেম্বর মাসের ডলারের দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু এক মাসে বাড়তি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা সাধারণত বাড়তি ব্যয় পণ্যের দামের সঙ্গে উঠিয়ে নেন। ফলে দেশের মানুষকে এ পরিমাণ অর্থ ছয়টি পণ্যের দামের সঙ্গে দিতে হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুধু ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নির্ধারণ করে। অন্য পণ্যগুলোর দাম নির্ধারণের উদ্যোগ থেকে মন্ত্রণালয় পিছিয়ে এসেছে। ফলে ডলারের দাম ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে যতটুকু দাম বাড়ার কথা, ঠিক ততটুকু বেড়েছে কি না তা জানা যাচ্ছে না। সুযোগ নিয়ে ব্যয়বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে কি না, তা–ও অজানা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে আমদানি মূল্য, বন্দর থেকে খালাস হওয়া তেলের মূল্য ও ঋণপত্রের দরের গড় করে ব্যয় বিবরণী অনুযায়ী ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে। এতে ৩ অক্টোবর লিটারে ১৪ টাকা কমানো হয় সয়াবিন তেলের দাম, নির্ধারণ করা হয় ১৭৮ টাকা। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলে আরও কম দামে তেল কিনতে পারতেন মানুষ।

ব্যবসায়ীরা এখনো উদ্বিগ্ন এ কারণে যে ডলারের বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। এখন আমদানির ঋণপত্র খুললে পণ্য বন্দরে আসার পর ডলারের দাম কত দাঁড়াবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাসলিম প্রথম আলোকে বলেন, ধীরে ধীরে ডলারের দর সমন্বয় করা হলে এ অবস্থা হতো না। ডলার কোথায় গিয়ে স্থির হয়, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান ডলার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে আমদানি করে কোন দামে দায় পরিশোধ করতে হয়, তার একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

শুধু নিত্যপণ্য নয়

ডলারের দামের কারণে সব ধরনের পণ্যের দামেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নিত্যব্যবহার্য সাবান, টুথপেস্ট, টিস্যু, শৌচাগার পরিষ্কারক (টয়লেট ক্লিনার) ও তৈজসপত্রের দাম বাড়ছে। বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে পানীয়, রুটি-বিস্কুট, শিশুখাদ্যসহ আমদানিনির্ভর (তৈরি খাবার ও কাঁচামাল) মোটামুটি সব ধরনের খাদ্য। শিক্ষা উপকরণ কাগজ, কলম ও পেনসিলের দামও বাড়তি। বেড়েছে পোলট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্যের দাম।

নির্মাণ খাতের উপকরণ রড ও সিমেন্টের দাম বেড়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।

যেমন পুরোনো লোহার টুকরা গলিয়ে রড তৈরি হয়। ডলারের দামের কারণে কাঁচামালের টনপ্রতি খরচ বেড়েছে ৮ হাজার ৭৫৯ টাকা। আবার সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে খরচ বেড়েছে টনপ্রতি ১ হাজার ১৫১ টাকা।

চট্টগ্রামভিত্তিক ভোগ্যপণ্য ও শিল্পপণ্য আমদানিকারক সী কম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ ভোক্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও ডলারের উচ্চ দামের মাশুল দিতে হচ্ছে। পণ্য বিক্রি করা শেষে দায় পরিশোধ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ডলারের দাম আরও বেড়েছে।

সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে

নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তিন ধরনের ডাল ও গম ছাড়া অন্যগুলোতে শুল্ক–কর দিতে হয়। শুল্ক–কর আদায়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কাস্টমস গত মে মাসে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। গত মাসে তা ৯৪ টাকা ৭৩ পয়সা ধরে হিসাব করা হয়। ডলারের দাম বাড়ানোর কারণে সরকারের শুল্ককর থেকে রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।

ধরা যাক, কোনো পণ্য আমদানিতে মোট করভার ২৫ শতাংশ। ৮৬ টাকা ডলার ধরলে ১ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে সরকার পাবে সাড়ে ২১ টাকা। আর ডলার প্রায় ৯৫ টাকা ধরার ফলে সরকার প্রায় পৌনে তিন টাকা বেশি পাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) আমদানি শুল্ক আদায় ৩৪ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ২২ ও সম্পূরক শুল্ক ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। ওদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ১৯, সম্পূরক শুল্ক ২৮ ও লেনদেন (টার্নওভার) কর ৪৪ শতাংশ কমেছে।

রাজস্ব আদায়ের এ চিত্র জানানোর পর মন্তব্য জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এর মানে হলো স্থানীয় বাজারে উৎপাদন ও কেনাবেচা কমে গেছে। অর্থনীতিতে চাহিদা কমেছে। এটা শুভ নয়। কারণ, এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। তিনি বলেন, এখন দরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলারের স্থিতিশীল ও একক দর। এ জন্য ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়াতে হবে।