Thank you for trying Sticky AMP!!

তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়

কারওয়ানবাজারের আন্ডারপাসে বহুদিন ধরে ভিক্ষা করছে আশা নামের দৃষ্টিহীন এই শিশু l ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ফটকের পাশে বসে ছিল বিকলাঙ্গ ও হাড্ডিসার শিশুটি। মাথার ওপর প্রচণ্ড রোদ। সামনে ভিক্ষার থালা। পাশে গিয়ে শিশুটির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সে নানা আকার-ইঙ্গিত করে। বোঝা গেল সে কথা বলতে পারে না। এ সময় মধ্যবয়সী এক লোক এসে বললেন, ‘কী হইছে, ভাই?’ শিশুটির নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর নাম রাজু। জন্মের পর থাইক্যা চলতে পারে না।’ আপনি শিশুটির কে হন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ওর চাচা লাগি। হেরে দেখা শোনা করতাছি।’ কথা বলার মাঝেই পানি আনার নাম করে তিনি চলে যান। আর কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাসে বহুদিন ধরে ভিক্ষা করছে আশা নামের একটি মেয়েশিশু। বয়স আনুমানিক দশ বছর। দৃষ্টিহীন শিশুটি আগে বসে থেকে ভিক্ষা করত এখন সে লাঠিতে ভর দিয়ে সারা দিন দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর পর এক ব্যক্তি এসে আশার হাতের টাকা নিয়ে যায়। আশার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করার এক মিনিটের মধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ব্যক্তি এসে বলেন, ‘কী হইছে? আমার লগে কথা কন।’ তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আশার বাবা, নাম জজ মিয়া।
বললাম, ‘আপনি তো সামর্থ্যবান, কাজ করতে পারেন। তাহলে অন্ধ শিশুকে এভাবে ভিক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে রাখেন কেন?’ জজ মিয়া রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আপনার কাম আপনে করেন গা।’
রাজধানীর পল্টন মোড়ে প্রচণ্ড রোদে একটি মেয়েশিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন মধ্যবয়সী আমেনা বানু। কখনো বাসে উঠে ভিক্ষা চাইছেন, কখনো রাস্তায় চলাচল করা মানুষদের কাছে, কখনো বা প্রাইভেট কারের জানালায় গিয়ে ভিক্ষা চাইছেন তিনি। কোলের শিশুটি তখন ঘুমাচ্ছিল। কথা বলতেই আমেনা বানু জানান, কোলের শিশুটির নাম মিনা। এক বছরের এই শিশু জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ। শিশুটির জন্মের পর তারা বাবা এই বিকলাঙ্গ শিশুকে দেখে তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। এর পর থেকে সংসার চালাতে না পেরে তিনি শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করছেন। শিশুটির কী অসুখ আর শিশুটি ঘুমাচ্ছে কেন—এসব প্রশ্ন করতেই আমেনা বানু কোনো কথা না বলে রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে দ্রুত হাঁটা দেন। ঘটনার কয়েক দিন পর সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকায় একই শিশুকে ঘুমন্ত অবস্থায়

কোলে নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা গেল আরেক নারীকে। কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, তাঁর নাম আকলিমা। এই শিশু তাঁর বোনের। বোন শিশুকে রেখে মারা গেছে। বোনের স্বামীও অন্যত্র চলে গেছে। তাই এই শিশুকে দেখাশোনার জন্য তাঁকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই শিশুকে নিয়ে এমন ভিক্ষা করার ঘটনা রাজধানীতে আরও অনেক ঘটছে। এই কাজগুলো করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় বিকলাঙ্গ শিশুদের সামনে এনে, কোলে শিশুদের কাঁদিয়ে, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে, অসুস্থ শিশুকে বসিয়ে রেখে ভিক্ষা চাওয়া হয়। এসব কাজে কখনো সরাসরি শিশুদের ব্যবহার করে বা কখনো শিশুর মা-বাবা সেজে অপরাধী চক্র ভিক্ষা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হাত নেই, পা নেই, অন্ধ, কঙ্কালসার দেহ, অস্বাভাবিক বড় মাথা ও হাত-পা, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা—এমন বেশ শিশু শহরময় ভিক্ষা করছে। কখনো কখনো এদের বহন করার জন্যও থাকে সুস্থ একজন লোক। তারা বিভিন্ন ক্ষতস্থান দেখিয়ে বা কোলে শিশু নিয়ে ভিক্ষা করে। তবে এসব শিশুর অধিকাংশই ভাড়া করা। বিভিন্ন বস্তির শিশুকে ৪০ থেকে ৫০ টাকার বিনিময়ে এসব ভিক্ষুকের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, শিশুদের নিয়ে এমন ঘৃণ্য ব্যবসা জমিয়ে তুলছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী চক্র। এসব চক্রের সদস্যরা হাসপাতাল থেকে নবজাতকদের চুরি করে তাদের পাতিলে ভেতর বসিয়ে রেখে সামান্য খাবার ও পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। এতে শিশুটি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। হয়ে যায় শারীরিক প্রতিবন্ধী। তখন তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। এ ছাড়া সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা কারও হাত কেটে দিচ্ছে, কারও পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করছে। এরপর তাকে নামানো হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে।
ঢাকার পুরোনো হাইকোর্টের পাশে থাকেন অনেক ভিক্ষুক। এখানের কয়েকজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও শিশুদের দিয়ে সংঘবদ্ধ চক্রের ভিক্ষা ব্যবসার কথা স্বীকার করেছে। এক ভিখারিণী বলেন, ‘বাচ্চা পোলাপানরা কান্দে। হের লাইগা ওগো ঘুমের ওষুধ খাওয়াই। তয় আমরা নিজেরাই ভিক্ষা করি। ওই সব খারাপ কাম করি না।’ গত বছরে বাংলাদেশ সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিসিএইচআরডি) নামে একটি সংস্থা ঢাকা শহরের ১০৩ জন শিশুভিক্ষুকের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক বলেন, ‘আমরা আমাদের জরিপ পরিচালনার সময় দেখেছি, অসুস্থ শিশুদের সকাল থেকে পথেঘাটে বসিয়ে রেখে রাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই শিশুদের নির্দয়ভাবে বসিয়ে রেখে সংঘবদ্ধ চক্র টাকা হাতিয়ে নেয়। ভিক্ষাবৃত্তিতে এভাবে শিশুদের ব্যবহার রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়্যারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবন্ধী বা সুস্থ শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করে একদল মানুষ অবৈধ সুযোগ নিচ্ছে। শিশুদের যারা এই কাজে ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ব্যবস্থা নিতে চায় না। বিষয়টি এড়িয়ে যায় তারা। এর বড় কারণ হচ্ছে শুধু শাস্তি দিলেই সমস্যার সমাধান হয় না; ওই শিশুদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এই শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র নেয়, তাহলে এই অবস্থার পরিবর্তন হতো। একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে, আমাদের দেশে শিশুভিক্ষুকদের সংখ্যাও রাষ্ট্রের কাছে নেই। এটি থাকলে হয়তো পরবর্তী ধাপে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছু ইতিবাচক সিন্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো। বাজেটে আলাদা করে তাদের নিয়ে কিছু করার থাকত। তাই এ বিষয়ে করণীয় এখনই রাষ্ট্রকে ঠিক করতে হবে।