Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সবকিছুই রাজনীতিকেন্দ্রিক

>

• আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের তিনটি ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি দল সক্রিয়।
• স্বজনপ্রীতি, ভবন নির্মাণে দুর্নীতিসহ ১১টি বিষয়ে শিক্ষকদের একাংশ ক্ষুব্ধ।
• ‘সামাজিকভাবে বয়কটের’ মুখে পড়েছিলেন উপাচার্য।

অরাজনৈতিক বলা হলেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসনিক পদের বিন্যাস, পদোন্নতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও বদলির মতো বিষয়গুলো হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। শিক্ষকদের অনেকেই ব্যস্ত দলাদলিতে, কেউবা অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় উপাচার্যকে ঘিরে, তাঁর নিয়োগও রাজনৈতিক বিবেচনায়। প্রথম দফায় নিয়োগ পেয়ে উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান সরকার-সমর্থক সব শিক্ষকের সহযোগিতা ও সমর্থন পান। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ পাওয়ার পর শিক্ষকদের একাংশকে কাছে নিয়ে তিনি অপরাংশকে দূরে ঠেলে দেন।

তবে মোটামুটি নিরপেক্ষ শিক্ষকদের একাংশ মনে করে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও শিক্ষকদের এই দলাদলিতে বিষয়গুলো চাপা পড়ে গেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১২ থেকে ১৭ আগস্টের মধ্যে সব পক্ষের অন্তত ২০ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের।

বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতামত প্রচার ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে সেখানে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের তিনটি ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি দল সক্রিয়। আওয়ামীপন্থীদের স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) উপাচার্যের পক্ষে ও বিপক্ষে আলাদা দুটি কমিটি আছে। এর বাইরে আছে বঙ্গবন্ধু পরিষদ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠনের নাম ন্যাশনালিস্ট টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এনটিএ)। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষক ৪০৬ জন।

উপাচার্যবিরোধী স্বাশিপের শিক্ষকদের অভিযোগ, কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগে উপাচার্যের স্বজনপ্রীতি, ভবন নির্মাণে দুর্নীতিসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট দাবিতে তাঁরা উপাচার্যের বিরোধিতা করছেন। আর উপাচার্য ও অন্য পক্ষের শিক্ষকেরা বলছেন, এ দূরত্ব ব্যক্তিস্বার্থের।

উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান স্বীকার করেন, শুরুতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরা তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন, তখন স্বাশিপ তাঁর পাশে ছিল। ফলে ওই শিক্ষকদের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতাও বেড়েছিল। এই নির্ভরশীলতায় ফাটল দেখা দেয় গত বছরের ২৬ জানুয়ারি ফায়েক উজ্জামান দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার পর। একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য একবার দায়িত্ব পালন করে চলে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ কেউ এই পদে আসতে চাইছিলেন, যা ক্ষোভের অন্যতম কারণ হতে পারে।

একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, উপাচার্য কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে ২৫-২৬ জন আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগে সেখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদেরই বেশি প্রাধান্য দেন।

এ ছাড়া নতুন একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করছে। এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘দুদকের কর্মকর্তাকে আমি বলেছি, যিনিই জড়িত থাকুন, তাঁর বিরুদ্ধেই যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ দুদকের খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‍+পরিচালক আবদুল গাফফার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অভিযোগটি আগের পরিচালক তদন্ত করছিলেন। তিনি বদলি হওয়ার পর নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত চাওয়া হয়েছে।’

আত্মীয়স্বজন নিয়োগ প্রসঙ্গে ফায়েক উজ্জামান বলেন, ‘আমি অস্বীকার করব না যে আমার আটজন আত্মীয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। কিন্তু এদের কাউকে নীতিমালা ভেঙে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্য সব অভিযোগ মিথ্যা।’

বয়কট, গণপদত্যাগ ও স্বাশিপে ভাঙন
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বার্তার ৭৭ তম সংখ্যায় (জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০১৮) গত মার্চ মাসের ২৬টি সংবাদ জায়গা করে নিয়েছে। সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর মধ্যে ১ থেকে ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত ১২টি কর্মসূচির ৮ টিতে উপাচার্য যোগ দিয়েছেন। কিন্তু ১৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৪টি সংবাদের মাত্র চারটিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল।

শিক্ষকেরা বলছেন, ওই সময়টাতে উপাচার্য ‘সামাজিকভাবে বয়কটের’ মুখে ছিলেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদ্যাপনের অনুষ্ঠান থেকে এই বয়কটের শুরু। স্বাশিপ নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপাচার্যকে অনুষ্ঠান উদ্যাপন কমিটির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হতো না। উপাচার্য এলেও তাঁকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হতো না।

উপাচার্যকে এড়িয়ে চলার এ সময়ে গত ২৭ মে স্বাশিপের নেতা ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালক আশীষ কুমার দাস অব্যাহতি চান। ৩০ মে ওই পদে বঙ্গবন্ধু পরিষদভুক্ত অধ্যাপক শরীফ হাসানকে নিয়োগ দেন উপাচার্য। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পরই ছাত্রবিষয়ক পরিচালকদের পদটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কাজগুলো তদারকি করেন এই পদে থাকা শিক্ষক।

স্বাশিপ অধ্যাপক শরীফের বদলে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য উপাচার্যকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু উপাচার্য তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় গত ১৪ জুলাই স্বাশিপের এক বৈঠক থেকে গণপদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়। দলীয় সিদ্ধান্তের আগেই ১০ জুলাই প্রশাসনিক তিনটি পদ থেকে পদত্যাগ করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি আফরোজা পারভীন। নবনিযুক্ত ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে অপারগতা জানিয়ে ১৮ জুলাই সহকারী পরিচালকেরা পদত্যাগ করেন। এসব পদেও উপাচার্য বঙ্গবন্ধু পরিষদের শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে থাকেন।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মাহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে নয়, স্বাশিপের ভেঙে যাওয়া অংশ থেকেও কাউকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

স্বাশিপের গণপদত্যাগের সিদ্ধান্ত না মেনে আলাদা আহ্বায়ক কমিটি করে অন্য একটি অংশ। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে একই নামে দুটি পক্ষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিলে স্বাশিপের ভাঙন প্রকাশ্য হয়।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও বিশ্ববিদ্যালয়প্রীতি
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশই রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় নেতাদের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই সম্প্রতি মেয়র নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। এমন অন্তত ১০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার ছবি প্রথম আলোর হাতে রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের দল এনটিএর সভাপতি রেজাউল করিমের অভিযোগ, এখন ঢালাওভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষকেরা অংশ নিচ্ছেন।

স্বাশিপের একাংশের আহ্বায়ক হোসনে আরা প্রথম আলোকে বলেন, এটি আদর্শের জায়গা থেকে শিক্ষকদের এক থাকা। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন বলেন, শিক্ষকেরা রাজনৈতিক দলাদলি করেন, সরাসরি এমনটা বলা যাবে না। বলা যায়, শিক্ষকেরা রাজনীতিসচেতন।

উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষকদের বলা হয়েছে, আপনারা রাজনীতি করেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কোনো ধরনের কর্মসূচি করা যাবে না।’

আগামী পর্ব পড়ুন: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা নিয়ে