Thank you for trying Sticky AMP!!

একজন অনন্য পিএইচডি সুপারভাইজারের ট্রাস্ট

উচ্চতর শিক্ষায় একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আঁকড়ে পড়ে থাকা ও মেন্টাল স্ট্রেসকে জয় করার অপর নামই পিএইচডি। সাধারণত, উত্তর আমেরিকায় চার থেকে সাত বছর লেগে যায় এটা শেষ করতে। ধাপে ধাপে পার হতে হয় এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা, কোর্স ওয়ার্ক থেকে শুরু করে কম্প্রিহেনসিভ এক্সাম ও বিভিন্ন প্রজেক্ট। এই দীর্ঘ পথে যেমন নিজের ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে হয়, তেমনি পারিপার্শ্বিক সাপোর্টও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ সাপোর্টের ঘাটতির কারণে পরিসংখ্যানমতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্যান্ডিডেট পিএইচডি অসম্পূর্ণ রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যান, যার অধিকাংশই নির্ভর করে সুপারভাইজার কেমন মানুষ, তার ওপর।

স্ট্রেস বাড়ার কারণও অমূলক নয়। প্রফেসর ফান্ডিং করছেন, তাঁর পেপার চাই। পেপার না থাকলে ফান্ডিং কমে যাবে বা বন্ধ হবে, প্রমোশন হবে না ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই প্রফেসর ম্যাক্সিমাম প্রডাকশন পেতে চাইবেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এটা সাধারণত বেশি হয়ে থাকে নন-টেন্যুর ট্র্যাক বা জুনিয়র প্রফেসরদের ক্ষেত্রে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে দিন-রাত ভুলে যেতে হয়, রাতেও থাকতে হয় ল্যাবে। কোনো কোনো সময় ল্যাবে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে।

চাইনিজ ও কোরিয়ান প্রফেসরদের নিয়ে অস্বস্তির সীমা নেই। পেপার অনেক হবে, কিন্তু জীবনের বারোটা বেজে চৌদ্দটায় গিয়ে ঠেকবে। তাঁদের স্টান্ডার্ড একমাত্র তাঁরাই ঠিক করবেন। আসলে এর দায় প্রফেসর হিসেবে নয়, দায় হতে পারে চায়নিজ বা কোরিয়ান হিসেবে। জাতি হিসেবে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে পারেন তাঁরা।

আমার ল্যাবের কথা বলতে পারি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লিমারিক পাল্প অ্যান্ড পেপার সেন্টার। তিনতলা বিল্ডিংয়ের বলতে গেলে প্রায় পুরোটাতেই পাল্প অ্যান্ড পেপারের কাজ হয়। ২৫ থেকে ৩০ জনের টিম, আমার মতো দু–একজন ছিটেফোঁটা বাদে সবাই চাইনিজ। এ কারণেই বিল্ডিংটাকে অনেকেই মজা করে চাইনিজ টাওয়ার বলে থাকেন। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গমগম করে। খাওয়া থেকে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ—সবই ল্যাবে থেকে করে, বাসায় যায় শুধু রান্না আর ঘুমাতে। তাদের স্ট্রেস লাগে না, তারা এমনই।

অল্প কিছু ব্যতিক্রম আছে বৈকি। আজকের লেখার কারণও তাই এক অনন্য সুপারভাইজারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাঁর নাম প্রফেসর ইয়াংহু নি। তিনি চাইনিজ। পেপার অ্যান্ড পাল্পের কানাডা রিসার্চ চেয়ার। গত বছর পেপার পাবলিশ করেছেন ৬০টিরও বেশি। সহজেই অনুমেয় তাঁর রিসার্চ–পাগলামোটা। টায়ার ১ রিসার্চার। তবে তিনি নিজ কাজে চাইনিজ, কিন্তু আচরণে চাইনিজ না। তিনি প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন, এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও (সপ্তাহে অফিসে থাকেন প্রায় ৯৮ ঘণ্টা)। হয়তো তিনি ট্রাস্ট করেন আমরাও তাঁকে অনুসরণ করি (চাইনিজ স্টুডেন্টরা অবশ্যই করে)। তবে মাঝেমধ্যে স্মরণ করায় দেন, প্লিজ, তোমরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা ল্যাবে কাজ করার নিয়ম অনুসরণ করো। তিনি আমাদের থেকে দ্বিগুণ কাজ করেন।

একটা অভিজ্ঞতা বলি। এখন করোনার কারণে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস–পরীক্ষা চলছে। আমার প্রফেসরের সহকারী হিসেবে কাজ করি। একটা মিডটার্ম পরীক্ষা হবে, অনলাইনে। প্রশ্ন আপলোড করে দেব, আর পরীক্ষার সময় এক ঘণ্টা পর ছাত্রছাত্রীরা উত্তরপত্রের ছবি তুলে বা স্ক্যান করে ১০ মিনিটের মধ্যে অনলাইনে আপলোড করবে। সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়। এরপর আর আপলোড করতে পারবে না।

প্রফেসরকে বললাম, উত্তরপত্র আপলোডের সময় কত করে দেব? তিনি বললেন, ‘এটা করার দরকার নেই, আমি তাদের ট্রাস্ট করি।’ তার মানে, তারা যদি চায়, এক ঘণ্টার পরীক্ষা দু–তিন ঘণ্টায় শেষ করে বা পরের দিনে শেষ করেও আপলোড করতে পারে, কোনো বাধা নেই। বাধা একটাই, প্রফেসর তাদের ট্রাস্ট করেন। তিনি আমাদের গ্রুপের সবাইকে ট্রাস্ট করেন। ফান্ডিংয়ের ঘাটতি নেই, কাজের স্বাধীনতা আছে। সবাই নিজ নিজ কাজে মগ্ন, প্রয়োজনে সহযোগিতার অভাব হয় না। প্রফেসর কাঁধের ওপর নিশ্বাস ফেলেন না, যা ইনডিপেনডেন্ট রিসার্চার হওয়ার বড় বাধা। প্রত্যেকের কাঁধের ওপর নিশ্বাস ফেলার সময়ও তাঁর নেই, মাসে একবার আউটপুট দেখবেন, ঠিক ট্রাকে আছেন কি না। না থাকলে অফিসে ডেকে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবেন, নির্দেশনা দেবেন। এটাই তাঁর স্টাইল, মানসিক স্ট্রেসমুক্ত এক পরিবেশ, যা প্রকৃত রিসার্চারদের জন্য আদর্শ। তিনি একাই আমাদের এ বড় গ্রুপের সবার খেয়াল রাখেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। এত দিনে একটিবারের জন্য ব্যত্যয় দেখিনি এই দীর্ঘ চার বছরে। একেবারে মামুলি বিষয় থেকে ক্যারিয়ার রিলেটেড প্রতিটি বিষয়ে। কবে কোনো ডেডলাইন আছে, কোনো ইভেন্ট আছে, এসব আমরা ভুলে গেলেও তাঁর ভুল হয় না কখনো, তিনি ঠিকই সঠিক সময়ে মনে করিয়ে দেন। আরও বড় গুণ, তিনি এখানকার সবার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়েও ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা করেন, গাইড করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক না থাকলে কাজে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ থাকবে না। শুধু তা–ই নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যাপারেও খেয়াল রাখেন, ওনার দিক থেকে গাইড করার চেষ্টা করেন। যিনি এত মানবিক, আন্তরিক, পরিশ্রমী, ও আমাদের নিয়ে সার্বক্ষণিক চিন্তা করেন, প্রতিটি বিষয়ে ট্রাস্ট করেন, তাঁকে কি ট্রাস্ট না করে পারা যায়?

*লেখক: নূর আলম, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা