Thank you for trying Sticky AMP!!

টুকিটাকি চত্বরে কী নেই

টুকিটাকি চত্বরের চেনা দৃশ্য। ছবি: শহীদুল ইসলাম

চত্বরের নাম টুকিটাকি। যাঁরা জানেন না, নাম শুনে হয়তো ভাববেন, এ আর এমন কী। এখানে আছেই–বা কী। আর যাঁরা জানেন, তাঁরা বলবেন, নাম টুকিটাকি তাতে কী, এখানে নেই কী! শিক্ষাবিষয়ক সকল প্রকার সওদা কেনা, খাওয়াদাওয়া করা, তিলের খাজা, নারকেলের নাড়ু, ইয়ারফোনের দোকান, খেজুরের রস, রঙিন বেলুন, ডাব, কলা, ছবির দোকান, অনলাইনে চাকরি খোঁজার বুথ, ওজন মাপার ব্যবস্থা, এমনকি পড়াশোনা নিয়ে আড্ডা—সেও চলে টুকিটাকি চত্বরে। শুধু শিক্ষার্থী নন, শিক্ষকেরাও থাকেন এর মধ্যে।

প্রায় ৩৫ বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি চত্বরে ‘টুকিটাকি’ নামের ছোট্ট একটি দোকান চালু হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে টুকিটাকি নামটি ছড়িয়ে পড়ে। দোকানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। সবার অজান্তেই একসময় লাইব্রেরি চত্বরটি হয়ে যায় টুকিটাকি চত্বর। একসময় যেখানে একসঙ্গে পাঁচজন শিক্ষার্থী দাঁড়াতেন না। এখন সেখানে সারা দিন শত শত শিক্ষার্থীর আনাগোনা। একজন আরেকজনকে ফোন করে বলেন, ‘চলে আয় টুকিটাকি চত্বরে। বাবুর দোকানে আছি।’ ব্যস, আর কিছু বলতে হয় না। ঠিকানা সবার চেনা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম স্মৃতি হাতড়ে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও একাডেমিক এলাকায় আগে কোনো হালকা খাবারের দোকান ছিল না। ফয়জুল নামের কম বয়সী একটা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল ও সৈয়দ আমির আলী হলের মাঝখানে ছোট্ট একটা দোকান করে জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের দিকে ছেলেরা তার দোকানটি আজকের এই টুকিটাকি চত্বরে এনে বসানোর পরামর্শ দেয়। দোকানের নাম দেওয়া হয় ‘ফয়জুল অ্যান্ড সন্স।’ ওই দোকানে শিক্ষার্থীদের নোট করার জন্য ভালো বাইন্ডিং খাতা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি জিনিসের পাশাপাশি হালকা খাবার রাখা হয়। দোকানটি জনপ্রিয় হয়। এর বছর দু-এক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কর্মচারী জয়নাল আবেদীন, যিনি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার হিসেবে অবসর নেন, তিনি ফয়জুলের দোকানের পেছনে একটি দোকান করেন। তৎকালীন উপাচার্য আমানুল্লাহ আহমদ তাঁকে অনুমতি দেন। জয়নাল দোকানের নাম দেন ‘টুকিটাকি স্ন্যাকস অ্যান্ড স্টেশনারি’। টুকিটাকি নামটি উচ্চারণ করা সহজ। উচ্চারণের মধ্যেও একটা মজা আছে। ফয়জুল অ্যান্ড সন্সকে ছাপিয়ে টুকিটাকি নামটি দ্রুত ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে পরপর দুটি রাকসু নির্বাচন হলো। এ সময় টুকিটাকির সামনে ব্যাপক আড্ডা হয়। নির্বাচন শেষ হয়, কিন্তু আড্ডা থেকে যায়। সেই হলো শুরু।

গত ৩১ জানুয়ারি টুকিটাকি স্ন্যাকস অ্যান্ড স্টেশনারিতে গিয়ে জয়নাল আবেদীনের ছেলে রফিকুল ইসলামকে পাওয়া যায়। তিনি ২০০৪ সাল থেকে দোকানে বসেন। তাঁর আগে দুই ভাই হামিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম বসতেন। তাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন। বললেন, বাবা জয়নাল আবেদীন ২০১০ সালে মারা গেছেন। এখন তিনিই দোকান চালান। সকাল সাড়ে আটটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন। তাঁদের দোকানের পাশে এখন আরও প্রায় ১৫টি দোকান চলছে। বেশ কয়েকটি ভাতের হোটেল চালু হয়েছে। তারা টুকিটাকি চত্বরে মোটা পলিথিন টাঙিয়ে দিয়েছে। নিচে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। তাতেই জমেছে আড্ডা। হোটেলে খেলে আড্ডা দেওয়া যায়, না খেলেও মানা নেই। একটি আড্ডায় দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মীর মেহবুব আলম ও তাঁর সামনে একই বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফিয়া ইসলাম, ইমরুল আসাদ, তানহা আলম, সঞ্চিতা রায়, শাহানাজ সুলতানা, পার্থ প্রতীম দে ও সৈয়দ আশরাফুল হক। তাঁরা একসঙ্গে বাবুর হোটেলে দুপুরের খাবার খেলেন। তখনো প্রার্থ প্রতীমের খাওয়া শেষ হয়নি। এরই মধ্যে এসে জুটলেন নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি রহমান রাজু ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৈকত আরেফিন।

 ‘সবাই একসঙ্গে খাচ্ছেন, বিল কে দেবে?’ জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা একযোগে বলে ওঠেন, ‘স্যারেরাই বিল দিয়ে দেন।’ শিক্ষক মীর মেহবুব আলম বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন বিল কে দেয়।’

তাঁর কথা শেষ না হতেই বিভাগের সভাপতি রহমান রাজু সবার খাবারের বিল দিয়ে দিলেন। এরই মধ্যে খাওয়া শেষ করে কী একটা বুঝে নেওয়ার জন্য প্রার্থ প্রতীম দে একটা নোট খাতা বের করলেন। মীর মেহবুব বললেন, ‘এখানে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবই চলে।’

হোটেলগুলোতে এত ভিড় কেন জানতে চাইলে হোটেলমালিক সবুজ বললেন, তাঁরা সস্তায় খাবার দেন। এক প্লেট ভাত ১০ টাকা, সবজি ৫ টাকা, নিরামিষ ৫ টাকা, মুরগির মাংস ২৫ টাকা ও গরুর মাংস ৪০ টাকা। কম দামে খাবার দেওয়ার রহস্যটা সবুজ একটু খুলে বললেন। তাঁরা লাভ কম করে বেশি বিক্রি করেন।

নাটোরের এক ব্যবসায়ী প্রতিদিন এখানে তিলের খাজা, মোয়া, মুড়কি, বাদামের কটকটিসহ প্রায় ১৫ পদের নাড়ু নিয়ে আসেন। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার টাকা বিক্রি হয়। ভালো বাজার মনে করে সাত মাস ধরে রবিউল ইসলাম শুধু ইয়ারফোন নিয়ে বসছেন। তিনিও বললেন, ‘ভালো বিক্রি হচ্ছে।’ ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসেছেন মানিক। তাঁরও নাকি ভালোই চলে। দেখা গেল বেশ কয়েকটি অনলাইন সার্ভিসের বুথ। তার পাশেই কলার ভ্যান, ডাবের ভ্যান। মাঝবয়সী এক ব্যক্তিকে খেজুর রসের হাঁড়ি নিয়ে ভিড়ের ভেতরে দেখা গেল। তাঁর পাশে দুই শিশু বিক্রি করছে রঙিন বেলুন। শিক্ষক সৈকত আরেফিন বললেন, ‘টুকিটাকি চত্বরে এখন কী নেই, এটাই দেখার বিষয়।’