Thank you for trying Sticky AMP!!

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল—আশাবাদী বাংলাদেশ

ভর্তির আবেদনে শিক্ষার্থীরা

শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবছেন মেডিকেলে ভর্তির সঙ্গে বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার কী সম্পর্ক? একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ৪ এপ্রিল প্রকাশিত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য ৪ হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। ভাবছেন, প্রতিবছরই মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা হয়, আসন অনুযায়ী কৃতকার্য ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয়। এ আর নতুন কী? একদম সঠিক। আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই ছাত্রী; সংখ্যায় ২ হাজার ৩৪১। একটু কি অবাক হচ্ছেন?

সংখ্যা কেবল সংখ্যাই নয়, এর রয়েছে এক অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। ভাবনার ডানাটা আরেকটু প্রসারিত করি। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই সাধারণত মেডিকেল বা চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়েন বা অন্যভাবে বললে, পড়ার জন্য নির্বাচিত হন। এ কথা সত্য, মেধাবী শিক্ষার্থীর অনুপাতে আমাদের আসনসংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে মেধা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বঞ্চিত হন। এ বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন। বলা বাহুল্য, তাঁরা সবাই মেধাবী। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, প্রতিযোগিতাটা কত তীব্র ছিল। এ যেন রীতিমতো এক যুদ্ধ! বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। এ রকম এক প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অধিকসংখ্যক ছাত্রীর নির্বাচিত হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। এ অবস্থা কেবল মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সবক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজমান। শিক্ষার সব স্তরে, সব বিষয়ে, মেয়েরা নিজেদের স্থান করে নিচ্ছেন স্বীয় যোগ্যতায়।

বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এ দেশের নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে শিক্ষার অভাবকে চিহ্নিত করেছিলেন। এ কথা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না, ধীরে ধীরে এ দেশের নারীরা শিক্ষার আলোয় নিজেদের আলোকিত করছেন, সঙ্গে আলোকিত করছেন গোটা সমাজ তথা দেশকে। গত তিন দশকে দেশে নারীশিক্ষায় এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে গেছেন পুরুষের তুলনায়।

সাইকেলে চেপে স্কুলের পথে মেয়েরা

কিছু পরিসংখ্যান বাংলাদেশের নারীশিক্ষার অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রার সাক্ষ্য বহন করে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিক্ষা ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে ছাত্রীদের হার প্রায় ৫১ শতাংশ। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছাত্রদের প্রায় সমান হয়ে গেছে। এ হার ৪৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক কিছুটা কম, ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে আশার কথা, এ হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী।

দেশের ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৬২৩ জন, যার মধ্যে ছাত্রী ২ লাখ ৫১ হাজার ৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার কিছুটা কম, ২৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ হাজার ৩৬০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছাত্রী আছেন ১২ হাজার ২৩৮ জন, অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। শিক্ষার্থী বিবেচনায় দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৩৬ হাজার ৬০৬ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ১২ হাজার ২৮। কৃষিশিক্ষায়ও এগিয়ে আসছেন মেয়েরা। দেশের বৃহৎ তিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার প্রায় ৪৪ শতাংশ। প্রকৌশলশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কিছুটা কম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ৮ হাজার ৮৫৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৩, যা প্রায় ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। চিকিৎসা, আইনসহ পেশাগত শিক্ষায় নারীরা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছেন পুরুষদের। পেশাগত শিক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণের হার ৫৪ শতাংশ।

সাফল্যে উদ্ভাসিত ছাত্রীরা

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, ২৫ শতাংশের মতো। যদিও ইউনেসকোর প্রতিবেদনে এ হার ২৮ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে; অন্যদিকে ইউসেপ বাংলাদেশের জরিপ অনুযায়ী, কারিগরি শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ। এ শিক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছাত্রীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা চালু করা হয়েছে। এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। ১৯৭১ সালে দেশে মোট নারী শিক্ষার্থীর হার ছিল মাত্র ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। উচশিক্ষার ক্ষেত্রে এই হার ছিল হতাশাজনক। স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর ৯ শতাংশ ছিলেন ছাত্রী। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশের মতো ছাত্রী পড়াশোনা করতেন। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে বুয়েট) ১ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন মাত্র ১২ জন। ময়মনসিংহে অবস্থিত একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রী ছিলেন না। মেডিকেল কলেজসমূহে ৩ হাজার ৩৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৬১১ জন।

নারীশিক্ষায় বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর সাফল্যের কারণ কী? নব্বই-পরবর্তী প্রতিটি সরকারের এ বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, নারীশিক্ষার বিস্তারে সদিচ্ছা ও নারীশিক্ষাবান্ধব নীতির ধারাবাহিকতা, পাশাপাশি নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এ সাফল্যের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ‘উপবৃত্তি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, পিছিয়ে পড়া জনপদ নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি প্রয়োগের ফলে এ উন্নতি আজ দৃশ্যমান। অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রেখেছে।

তবে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। যেতে হবে আরও অনেকটা পথ। এখনো মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ৪০ শতাংশ। শিক্ষা খাতে আমাদের বরাদ্দ জিডিপির ২ থেকে আড়াই শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা শিক্ষা খাতে যথাক্রমে জিডিপির ৩ দশমিক ৮, ৩ দশমিক ৭ ও ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় করে, ভুটানের শিক্ষা খাতে ব্যয় সবচেয়ে বেশি, জিডিপির ৬ শতাংশ। ইউনেসকো এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কে একটি দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এই ফ্রেমওয়ার্কের অনুস্বাক্ষরকারী ও সমর্থনকারী একটি দেশ। আমরা যদি জিডিপির ন্যূনতম ৪ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করি, বাংলাদেশ আরও দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে।
আলোচনার শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক। উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের সঙ্গে বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার সম্পর্ক তবে কী? বিখ্যাত ফরাসি বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘Give me an educated mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation—আমাকে একজন শিক্ষিত মা দিন, আমি আপনাকে একটি সভ্য ও শিক্ষিত জাতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’

*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত

Also Read: ধনতন্ত্রের দেশে সমাজতন্ত্রের হাওয়া