Thank you for trying Sticky AMP!!

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এম রোস্তম আলীর ১০১ অনিয়ম তদন্তের দাবিতে একক প্রতীকী অনশন কর্মসুচি পালন করেছিলেন বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম আবদুল আলীম

ব্যবস্থা না নিলে তদন্তের কী দরকার

দেশে এখন অর্ধশতাধিক পাবলিক বিদ্যালয়। আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পথে আছে। কিন্তু বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে কেমন চলছে? গবেষণার অপ্রতুলতাসহ শিক্ষার মান নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা রকমের অনিয়মেরও অভিযোগ উঠছে। শুধু অভিযোগ উঠছে তা নয়, দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইউজিসির তদন্তেও অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর কি কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হয়? এর উত্তর হলো সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই। বরং অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কষ্ট করে তদন্ত করে সরকারের (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়, কিন্তু এরপর সেগুলো চাপা পড়ে যায়। ফলে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মও থামছে না। বরং অভিযুক্ত উপাচার্যরাও বহাল তবিয়তে থেকে আরও অনিয়ম করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।

সর্বশেষ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সদ্য সাবেক উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখের সময়ে অনিয়মের সত্যতা পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ইউজিসি। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের যেমন মৌখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক বেশি নম্বর দিয়ে প্রথম করা হয়েছে, তেমনি মৌখিক পরীক্ষার নম্বর টেম্পারিং (কাটাকাটি) করেও নিয়োগ দেওয়ার তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপিত পদের দ্বিগুণের বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে অনিয়ম করে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রফিকুল ইসলামের ভাই, শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

ইউজিসির এই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগের এসব কার্যক্রম বাতিল হিসেবে গণ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অনিয়মের কারণে উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সেলিম হোসেনের বিরুদ্ধে ‘বিধি মোতাবেক’ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী। পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে, অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যতটা আগ্রহ থাকে, ‘অদৃশ্য কারণে’ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর আর সেই আগ্রহ দেখা যায় না।

সম্প্রতি ঢাকার বছিলা এলাকায় অবস্থিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও তদন্ত করেছে ইউজিসি। এর প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। ইউজিসির সূত্রগুলো বলছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়োগ-পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা থেকে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টিই আরও স্পষ্ট হয়। এ বিষয়ে প্রথম আলোতেই ছাপা কয়েকটি ঘটনার ওপর আলোকপাত করলেও বিষয়টি বোঝা যায়। যেমন গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউজিসি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খান অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; যদিও স্ত্রীর নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়। তদন্ত কমিটির কাছে উপাচার্য নিজের ‘অন্যায়’-এর কথা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে যেটি হচ্ছে, বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে পছন্দের লোকদের স্থায়ী করা বা নিয়োগের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে সেখানকার শিক্ষকেরাই বলছেন। এসব নিয়ে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেট সভায় কোনো কোনো সদস্য আপত্তিও জানিয়েছেন।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করেছিলেন। এ জন্য ইউজিসি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি প্রথমবারের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ করার কথাও ভেবেছিল। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন ইউজিসিও ‘কিছুটা নমনীয়’ হয়ে গেছে।

গত জানুয়ারিতে ইউজিসি সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। এতে দেখা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অস্থায়ীভাবে দেওয়া এসব নিয়োগে উপাচার্যের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সংসদ সদস্যের স্বজনেরা রয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ল্যাবরেটরি স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ইউজিসি থেকে কোর্স ও সিলেবাসের অনুমোদন দেওয়ার আগেই ল্যাবরেটরি স্থাপন করে প্রায় ছয় কোটি টাকার বিলও পরিশোধ করা হয়ে গেছে। এ নিয়ে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা ভবনে সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম বা বিভাগ চালু করার মতো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। বিভাগ অনুমোদনের আগেই ৫ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ‘বিগ ডেটা ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে, যা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু তথ্য উদ্‌ঘাটন পর্যন্ত দায়িত্ব শেষ।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুনাজ আহমেদ নূরের মেয়াদ শেষে এখন একজন সহ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সংবাদ সম্মেলন করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এগুলো করা হচ্ছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর প্রশাসন এভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। এ জন্য এসব নিয়োগ বাতিল এবং উপাচার্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছিল ইউজিসির তদন্ত কমিটি। কিন্তু ব্যবস্থা তো হয়ইনি, উল্টো তিনি তাঁর মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে বিদায় নেন। ইউজিসি তখনো তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অভিযোগ আছে, তদন্ত প্রতিবেদন ‘পছন্দ না হওয়ায়’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের তদন্ত পুনর্গঠন করে ইউজিসির আরেক সদস্য দিয়ে আরেক দফায় তদন্ত করায়। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে কী আছে বা তার ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কেউ জানতে পারেনি। এ নিয়ে ইউজিসির কর্মকর্তারাও বিরক্ত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁদের মনে হয়, ‘নানা কারণে’ মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও চেপে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের পরামর্শ নিয়ে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তার উদ্যোগও মন্ত্রণালয় নেয় কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন।

অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে আন্দোলন হলে কখনো কখনো কোনো কোনো উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও অপরাধের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একমাত্র রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল জলিল মিয়াকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল এবং মেয়াদের একেবারে শেষ মুহূর্তে সরকার তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল। উদাহরণ দেওয়ার মতো আর কোনো ঘটনা দেখা যায় না। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, যদি ব্যবস্থাই না নেওয়া হবে, তাহলে শুধু শুধু তদন্ত করে কী লাভ? বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনিয়ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে তো এগুলো চলতেই থাকবে। তাই দেশের উচ্চশিক্ষায় অন্তত উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

Also Read: রুয়েট উপাচার্যের পছন্দের নিয়োগে নম্বরপত্রে কাটাকাটি