Thank you for trying Sticky AMP!!

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখায় অগ্রগতি কত দূর

আইজ্যাক আসিমভ

গল্পটা এই দুনিয়ার নয়। তবে তা পড়েন এই দুনিয়ার মানুষেরাই। সে গল্পে থাকে অদ্ভুত ও অসাধারণ কিছু, যা মানুষ করতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ তা করতে চায়। ভাবনাজগতে এমন দোলা দিয়ে যুগে যুগে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি (সায়েন্স ফিকশন) লিখছেন লেখকেরা। এসব লেখার পাঠকও অনেক।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ভক্তদের জন্য আজ শনিবার বিশেষ একটি দিন। আজ সায়েন্স ফিকশন ডে। এদিনে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ভক্তদের উৎসাহ ও আগ্রহ তৈরিতে আলোচনা, মেলাসহ নানা আয়োজন হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি অবশ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। আর বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা বা আয়োজনও তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে কিছু সংগঠন চেষ্টা করছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাঠকদের আরও উৎসাহ দিতে।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখা মূলত পাশ্চাত্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের লেখকেরাও এই ঘরানার গল্প লেখায় পিছিয়ে নেই। সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও সাহিত্যের এই শাখার পাঠক এ দেশে অনেক। প্রতিবছর বইমেলা এলেই বই কেনা ও পড়ার একটা ধুম পড়ে। মেলায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই দেদার বিক্রি হয়। তবে সে হারে এই ঘরানার লেখকের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ে না। গত তিন বছরে বাংলা একাডেমির বইমেলায় যত বই বেরিয়েছে, তার ১ দশমিক ৬১ শতাংশ হচ্ছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই।
বাংলা একাডেমি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের বইমেলাতে মোট ১১ হাজার ২৪১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই ২০১৮ সালে ৫৩টি, ২০১৯-এ ৫৮টি ও সর্বশেষ বইমেলায় ২০২০ সালে ৬৭টি বেরিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটির হিসাবে, সারা দেশে এখন নিয়মিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকের সংখ্যা ৩২। সোসাইটির সভাপতি মোশতাক আহমেদ নিজেও একজন বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক। তাঁর প্রথম সায়েন্স ফিকশন বই বের হয় ২০০৫ সালে। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা ৪২টি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বের হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ঘরানায় আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এখানে হুমায়ূন আহমেদ লেখা শুরু করে মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। পাঠকের সংখ্যাও আছে অনেক বেশি। ভালো মানের সায়েন্স ফিকশন লেখার জন্য বাংলা একাডেমি লেখকদের পুরস্কারও দিচ্ছে।’

বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাঠকের চাহিদা অনেক। তবে সে পাঠকের তুলনায় বই বা গল্পের চাহিদা অনেক কম। বিশেষ করে মৌলিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল।
এ বিষয়ে তরুণ লেখক আদনান মুকিত প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা সাহিত্যে বর্তমানে যাঁরা কল্পকাহিনি লিখছেন, তাঁরা বিদেশি ধারা থেকে বের হতে পারেননি। সব গল্পই একটা গৎবাঁধা স্পেস শিপ, গবেষণাগার, গ্রহ—এমন ছাঁচে আটকা পড়ছে। যাঁরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখছেন, তাঁদের এই ধারা থেকে বেরিয়ে মৌলিক লেখায় জোর দেওয়া জরুরি।

অবশ্য মোশতাক আহমেদও একই সুরে বললেন, সায়েন্স ফিকশন লেখাটা খুব সহজ কাজ নয়। অনেকে চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। গ্রহ, বায়োলজিক্যাল সায়েন্স আর সমাজ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখতে গেলে আসবেই। তবে অন্য কারোর গল্পের সঙ্গে যেন না মেলে বা মৌলিক গল্প তৈরি হয়, এটিতে জোর দিতে হবে। দেশের লেখকদের অনেকেই সে চেষ্টা করছেন।

যেভাবে এল সায়েন্স ফিকশন ডে

২ জানুয়ারি প্রখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক আইজ্যাক আসিমভের জন্মদিন। প্রতিবছর এই দিনেই অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল সায়েন্স ফিকশন ডে হিসেবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির ভক্তরা পালন করে। তবে বাংলাদেশে এই দিবস উদ্‌যাপনের বড় আকারের আয়োজনের খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি গত পাঁচ বছরের মতো এবারও সংক্ষিপ্ত আকারে দিনটি উদ্‌যাপন করছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য এবারের আয়োজনের পুরোটা হচ্ছে অনলাইনে। আজ সন্ধ্যা নাগাদ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখার কর্মশালা ও কুইজ প্রতিযোগিতা হবে আজকের আয়োজনে।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বিগ-থ্রি

বিজ্ঞান কল্পকাহিনির কথা লিখতে গেলে লিখতে হবে ‘বিগ থ্রি’র কথা। এই বিগ-থ্রির একজন হচ্ছেন আইজ্যাক আসিমভ। তাঁকে এ জগতে গ্র্যান্ডমাস্টার বলা হয়। রাশিয়ান বংশোদ্ভূত এই মার্কিন অধ্যাপক বিজ্ঞান গল্প লেখায় পটু ছিলেন। তিনি পাঁচ শতাধিক বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাজ হচ্ছে ফাউন্ডেশন সিরিজ। তাঁর ‘নাইটফল’ গল্পটি ১৯৬৪ সালে সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অব আমেরিকা কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি শীর্ষক ছোটগল্পের সম্মান পায়।
বিগ-থ্রির বাকি দুজন হলেন রবার্ট এ হাইনলেইন ও আর্থার সি ক্লার্ক। এর মধ্যে রবার্ট জীবনের প্রথম দিকে লিখতেন অ্যাকশন ও রোমাঞ্চধর্মী লেখা। এরপর রবার্ট যোগ দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ১৯৪৭ সালে রবার্ট আবার লিখতে শুরু করেন। এবার হাত দেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে। সে বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ‘রকেট শিপ গ্যালিলিও’। এরপর একটানা লিখে গেছেন। বিচিত্র বিষয়, প্রযুক্তি ও চরিত্র তুলে ধরার আলাদা ঢঙে তাঁর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে ‘দ্য গ্রিন হিলস অব আর্থ’, ‘ডাবল স্টার’, ‘সিটিজেন অব দ্য গ্যালাক্সি’ এবং ‘মেটুজেলাস চিলড্রেন’ উল্লেখযোগ্য।
অডিসি সিরিজের স্রষ্টা আর্থার সি ক্লার্ক হচ্ছেন বিগ-থ্রির সর্বশেষ জন। তিনিই প্রথম কল্পকাহিনির মাধ্যমে উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগের ধারণা দেন। এই ধারণা তিনি তুলে ধরেন ১৯৪৫ সালে লেখা একটি বিজ্ঞান প্রবন্ধে। তিনি তিন শতাধিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের মতে, বাংলায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনি প্রথম লেখেন হেমলাল দত্ত। তবে এ নিয়েও মতভেদ আছে। অনেকের মতে অবশ্য বাংলা ভাষার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছেন আচার্য স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।
১৮৮২ সালে হেমলাল দত্তের লেখা দুই কিস্তির রহস্যগল্পকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশন। সে গল্পে নগেন্দ্র নামে এক লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি তার বন্ধু হার্বির বাড়ি গিয়ে নানাভাবে মুগ্ধ হন। গাড়িতে করে হার্বির বাড়িতে ঢুকতেই ফটক খোলা-বন্ধ হওয়া, ঘণ্টা বেজে সবাইকে সতর্ক করা, চৌকির ওপর দাঁড়াতেই কোট, প্যান্ট, জুতা পরিষ্কার করা—এমন সব নিত্যকার টুকিটাকি নানা কাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়াতে নগেন্দ্রর বর্ণনায় গল্প এগোয়।
এর ১৪ বছর পর ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’কে অনেকে বিবেচনা করেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে। মাথায় দেওয়া তেল দিয়ে এক অদ্ভুত ঘূর্ণিঝড়কে কাবু করার এই গল্প সাধু গদ্যে আর উত্তম পুরুষে লেখা।

মোটা দাগে বাংলাদেশে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখালেখির বয়স তিন দশক ধরে। এত আগে শুরু হলেও বাংলা সাহিত্যে এই ঘরানাটির খুঁটির জোর এখনো ততটা শক্ত নয়। প্রকাশকেরা অবশ্য বলছেন, দেশের কথাসাহিত্যে তরুণ পাঠকদের কাছে গত দুই দশকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। এই ঘরানার ভক্ত পাঠক ও লেখক বেড়েছে অন্য যেকোনো ঘরানার বইয়ের তুলনায়। তবে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের একটি অংশ ইংরেজি অনুবাদ ও ইংরেজি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখার সাহায্য নিয়ে বাংলায় লিখছেন, যার ধারাবাহিকতা থাকলে খুব বেশি দিন টিকবে না।
প্রকাশকদের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ জানান, গেল বইমেলায় তাঁর প্রকাশন থেকে চারজন লেখকের প্রায় ৩০ হাজার বই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ‘গ্লিনা’।
ফরিদ আহমেদ বলেন, সাহিত্য হচ্ছে যেখানে ধারাবাহিকতা থাকবে, কালের বিবর্তন থাকবে। আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হচ্ছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের বিবর্তন, বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা তাতে থাকতে হয়। এই দুটি একটু আলাদা।
যাঁরা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় লিখে চর্চা করছেন, তাঁদের ধারাবাহিকতা থাকবে না। কারণ, এখনকার পাঠকেরা, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণেরা অনেক সচেতন।