Thank you for trying Sticky AMP!!

২২ বছর বয়সেই বাজিমাত করেছেন যাঁরা

স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে সাকিব আল হাসান, প্রত্যেকে ২২ বছর বয়স থেকেই আলো ছড়াতে শুরু করেছেন

ঝকঝকে নতুন ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে ২০২২। আশা আর রোমাঞ্চ নিয়ে আমরা তাকিয়ে আছি '২২' সংখ্যাটার দিকে। সংখ্যাটি কি আমাদের জাতীয় কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষ কোনো জায়গা দখল করে থাকবে? কে জানে! তবে নতুন বছরের উপলক্ষ ছাড়া 'বাইশ' কিন্তু মাইলফলক হয়ে আছে অনেকের জীবনেই। বলছি ২২ বছর বয়সটার কথা। অদ্ভুত একটা সময়। 'পারব' বলে জমিয়ে রাখা ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলার বয়স বাইশ। 'করব' বলে ছেড়ে আসা স্বপ্নটাকে সত্যি করে ফেলার বয়স। ২০২২ সালের প্রারম্ভে চলুন, ২২ বছর বয়সের কিছু সাহসী, স্বপ্নিল গল্প থেকে প্রেরণা নেওয়া যাক।

বিদ্রোহী বাইশ

কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের এক দোতলা বাড়ি। দোতলার জানালার পাশে রাখা একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলে কালি, কলম আর একতাড়া কাগজ। তবে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে ২২ বছরের যে তরুণ একমনে লিখে চলেছেন, তাঁর হাতে কাঠপেনসিল। ভোররাতে লেখা শেষ হলো। তখন তখনই কাউকে সেটা পড়ে শোনানোর জন্য মনটা তড়বড় করছিল। পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললেন ঘুমন্ত বন্ধুকে। ডিসেম্বরের সেই রাতে প্রথমবারের মতো ধ্বনিত হলো—

'আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!

আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!'

মাত্র ২২ বছর বয়সে 'বিদ্রোহী' নামের কালজয়ী এই কবিতা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইন্টারনেটবিহীন এক পৃথিবীতে বসে ২২ বছরের তরুণ কবিতায় বলছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা, বলশেভিক বিপ্লবের কথা, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাবের কথা। ব্রিটিশ শাসনের মুঠোর মধ্যে বসেও নির্ভীক নজরুল লিখেছেন সবকিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলার কথা। ২২ বছর বয়সে তাঁর রাজনীতি সচেতনতা যেমন প্রবল ছিল, তেমনি তুখোড় ছিল কাব্যপ্রতিভা। বিপ্লব আর কাব্য, দ্রোহ আর ছন্দ তাই 'বিদ্রোহী'তে মিলেমিশে একাকার।

পরের মাসেই সাপ্তাহিক 'বিজলী'তে প্রথম ছাপা হয় 'বিদ্রোহী'। ২২ বছর বয়সী নজরুল সেবার এমন সাড়া ফেলে দিলেন যে সে সময়ের স্মৃতিচারণায় কবিবন্ধু মুজাফ্‌ফর আহমদ লেখেন, এই কবিতার জন্যই বৃষ্টি হওয়ার পরও কাগজের চাহিদা এত হয়েছিল যে সেই সপ্তাহে কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। 'বিদ্রোহী'র বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের কাছেও। শেষ পর্যন্ত কবিতাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা হলেও শুরু হলো এক অদ্ভুত প্রথা। 'বিদ্রোহী'সংবলিত পত্রিকা দেখলেই সেগুলো জব্দ করা শুরু করেন ইংরেজ শাসকের প্রতিনিধিরা।

বিপ্লবী বাইশ

মুহাম্মদ আলীর নাম তখন ক্যাসিয়াস ক্লে। মাত্র শুরু হয়েছে তাঁর জয়যাত্রা। ২২ বছর বয়সে প্রথমবার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার আগেই তিনি জোর কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন, 'ফ্লোট লাইক আ বাটারফ্লাই, স্টিং লাইক আ বি!' (প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াও, মৌমাছির মতো হুল ফোটাও!) মিয়ামির বক্সিং রিংয়ে সেবার রীতিমতো 'আপসেট' ঘটিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ক্যাসিয়াস ক্লে। বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী, বাজিকরদের হিসাব-নিকাশ—সব ভুল প্রমাণ করে সেবার শিরোপা জিতে সর্বকনিষ্ঠ হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নের রেকর্ড করেছিলেন তিনি।

তবে শুধু জয়ের জন্যই কি বিশেষ ২২? না, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের নেশায় মেতে ওঠার এ বয়সটি পালাবদলের সময়ও বটে। এ বয়সের উপলব্ধি, এ বয়সের ভাবনা, এ বয়সের সিদ্ধান্ত জয়ের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২২ বছর বয়সেই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং জানতে পারলেন, তিনি মরণব্যাধি মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত।

তবে জয়েই শেষ হয়নি সেদিনের গল্প। পরদিন নিজের দাস নামও বদলে ফেলেন তিনি। 'ক্যাসিয়াস ক্লে'র বদলে তাঁর নতুন নাম হয় 'ক্যাসিয়াস এক্স'। ক্রীতদাস প্রথায় নিয়ম ছিল কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের নাম বদলে দেওয়া। নামবদলের মাধ্যমে দাস হিসেবে বিক্রি হওয়া মানুষের ইতিহাস ও অতীতকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হতো। আর মুহাম্মদ আলী যখন তাঁর দাস নাম পরিবর্তন করলেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন-প্রতিবাদে উত্তাল। হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পরপরই নাম পরিবর্তন তাই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত এই বক্সারের প্রথম সরাসরি প্রতিবাদ। ২২ বছর বয়সী ক্যাসিয়াস এক্স সেদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'এক্স হলো আমার পূর্বপুরুষদের সেই অতীত ইতিহাসের প্রতীক, যা শ্বেতাঙ্গরা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।' পরে ধর্মান্তরিত হয়ে এ নামটিও বদলে হয়ে যান মুহাম্মদ আলী।

বাইশের বল

সাম্প্রতিক সময়েও কিন্তু বহুবার শোনা গিয়েছে বাইশের জয়ধ্বনি। আমাদের সাকিব আল হাসান ২২ বছর বয়সে এক দিনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন। স্টিফেনি ওয়ালশ নামের এক আলোকচিত্রী ২২ বছর বয়সে পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। ২২ বছর বয়সেই প্রথম ব্যালন ডি অর জেতেন বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসি। সিলভার লাইনিং প্লেবুক চলচ্চিত্রের অদ্ভুত, বিষণ্ন টিফানি ম্যাক্সওয়েলকে মনে আছে? সেই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে ২২ বছর বয়সেই অস্কার জিতেছিলেন জেনিফার লরেন্স।

তবে শুধু জয়ের জন্যই কি বিশেষ ২২? না, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের নেশায় মেতে ওঠার এ বয়সটি পালাবদলের সময়ও বটে। এ বয়সের উপলব্ধি, এ বয়সের ভাবনা, এ বয়সের সিদ্ধান্ত জয়ের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২২ বছর বয়সেই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং জানতে পারলেন, তিনি মরণব্যাধি মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা বললেন, তাঁর আয়ু আর মাত্র চার-পাঁচ বছর। সে সময় নিয়ে হকিংয়ের বক্তব্য, 'হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই মনে হলো, আমার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। পরক্ষণেই উপলব্ধি করলাম, জীবন ভীষণ সুন্দর, আরও বহু কিছু করা বাকি।' বাইশের এই উপলব্ধিই এই কিংবদন্তিকে দিয়েছে পরবর্তী জীবনের অনুপ্রেরণা। তিনি বেঁচে ছিলেন ছিয়াত্তর বছর বয়স পর্যন্ত।

বাইশের সিদ্ধান্ত

নিজের প্রথম বই 'ছেলেদের রামায়ণ' ছাপা ও মুদ্রণ নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। নিজেই তাই বই বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজ খরচে বিদেশ থেকে আধুনিক মুদ্রণ যন্ত্রপাতি আমদানি করলেন উপেন্দ্রকিশোর। ২২ বছর বয়সে নেওয়া তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাংলা বইয়ের জগৎকে পালটে দিয়েছিল। প্রাচ্যে তখন এ বিষয়ের চর্চা একেবারেই ছিল না। তবু পিছিয়ে থাকেননি উপেন্দ্রকিশোর। ছাত্রজীবনে অঙ্কে-বিজ্ঞানে বরাবরই মনোযোগী ছিলেন। সেই গভীর জ্ঞান আর সূক্ষ্ম বোধ নিয়ে কলকাতায় বসেই মুদ্রণের অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সে বছরই, অর্থাৎ ২২ বছর বয়সেই শিবনারায়ণ দাস লেনে বাড়ি ভাড়া নিয়ে 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন তিনি। এই ছাপাখানাই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণশিল্প বিকাশের আঁতুড়ঘর। এখান থেকেই পরে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় ছোটদের সেরা পত্রিকা 'সন্দেশ', পাল্টে যায় বাংলা বইয়ে ছাপার অক্ষর ও ছবি সংযোজনের ধরন।

ইতিহাসের পাতায় পাতায়, জয়ীদের জীবনের খাতায় এভাবেই বারবার মাইলফলক হয়ে ওঠে '২২'। ২২ অমিত সম্ভাবনার কথা বলে, ২২ ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জোগায়। নতুন বছর এলে যেমন আমরা ভাবি স্বপ্নপূরণের আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল, বাইশও তো সেই স্বপ্ন পূরণের সাহসই দেয়। এই বাইশে তাই বাইশের শক্তি হোক আপনার সঙ্গী। বয়স যতই হোক না কেন, ২০২২-এ নাহয় আমরা সবাই মিলে বাইশ–ই হব!