Thank you for trying Sticky AMP!!

নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের আরও এক দুঃসাহস

ওপেন কাপল নাটকে অভিনয় করেছেন জিয়াউল হাসান ও সারা যাকের

বাংলাদেশের নাট্যচর্চা জগতে প্রচল আছে যে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক নাট্যকারদের প্রতি একধরনের তীব্রানুরাগ আছে, যার প্রমাণ, এ পর্যন্ত তাদের মঞ্চায়িত নাটকের সিংহভাগই অনূদিত। তবে তাদের অভিনীত মৌলিক নাটকের তালিকাটিও মোটামুটি দীর্ঘ তো বটেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যও বটে। এই দল এ দেশের দর্শকদের একাধিক মৌলিক ও অনুবাদ নাটক উপহার দিয়ে দেশজ ও আন্তর্জাতিক নাট্যনন্দনচর্চায় দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে এবং এই শিল্পকে যারপরনাই সমৃদ্ধ করেছে। সেই পরম্পরায় নাগরিকের সাম্প্রতিক দুঃসাহস ওপেন কাপল।

ওপেন কাপল দারিও ফো ও তাঁর স্ত্রী ফ্রানকা রামের লেখা নাটক। ইতালির এই দম্পতি যৌথভাবে বেশ কিছু নাটক রচনা করেছেন, যার মধ্যে কয়েকটি সুমঞ্চায়িত একক নাটকও আছে। বাংলাদেশে দারিও ফো কোনো অপরিচিত নাম নয়, যদিও আমার জানামতে, এ পর্যন্ত তাঁর একটি নাটকই অনূদিত ও মঞ্চায়িত হয়েছে বাংলাদেশে—ডেথ আভ অ্যান অ্যানারকিস্ট। ওপেন কাপল দ্বিতীয়। দারিও ফো ও ফ্রানকা রামে রচিত যৌথ নাটকগুলোর অধিকাংশই, কিংবা বলা যায় সব কটিই, সমাজে নারীর প্রান্তিক অবস্থান, তাদের ওপর পুরুষের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এবং সর্বোপরি নারী সম-অধিকার, এমন প্লটের আশ্রয়ে লেখা। ওপেন কাপল সেই ঘরানারই একটি নাটক। যদিও নাটকটি রচিত ১৯৮৩ সালে, সারা যাকের এটি একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের নারী-পুরুষের, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের হালফিল চালচিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একটি সফল রূপান্তর করেছেন বলে আমি মনে করি।

সারা যাকের নিজেই বলছেন, তিনি নাটকটি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন—বাংলাদেশের রক্ষণশীল দর্শকেরা নাটকের থিম ও খোলামেলা সংলাপ সহজভাবে গ্রহণ করবে কি না। তিনি বলছেন, ওপেন সম্পর্ক অনেককাল ধরে আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিরাজমান। এখন হয়তো তরুণসমাজের ভেতর ওপেন শব্দটাও এসে পড়েছে।...মানুষ সারা জীবন পার করে একজনের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। এই বিবাহ নির্মাণ বা এই প্রতিষ্ঠানকে অটুট রাখতে যৌন স্বাধীনতা কি তার সমাধান?

স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, নাটকে দাম্পত্য জীবনে খোলামেলা সম্পর্কের বিষয়টি স্থান পেয়েছে—অর্থাৎ নাটকের দম্পতি অন্য পুরুষ ও নারীর প্রতি সম্পর্ক স্থাপন করলে স্বামী বা স্ত্রী উভয়েই সেটা মেনে নেবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে সেটা কতটা কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য? বিষয়টি নিয়ে দারিও ফো এবং তাঁর স্ত্রীই শুধু বিড়ম্বিত ছিলেন না, এই কাতারে আরও অনেক লেখকই আছেন। ১৯৬৮ সালে স্ত্রী বিনিময় (ওয়াইফ সোয়াপিং) নিয়ে কাপলস উপন্যাস লিখেছিলেন মার্কিন ঔপন্যাসিক জন আপডাইক। মনে পড়ে, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ দেশেও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ভেতর এমন স্ত্রী বিনিময়-আচার প্রচলিত ছিল বলে গোপন প্রচার আছে, যদিও এই বিষয় নিয়ে কোনো নাটক বা উপন্যাস রচিত হয়নি। তবে প্রসঙ্গক্রমে সেই ষাটের দশকে লেখা আবদুল গনি হাজারীর লেখা কবিতা ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’র কথা মনে উঠে আসে। দাম্পত্য জীবনের খোলামেলা সম্পর্ক নিয়ে অতিসম্প্রতি (২০০৬ সালে) স্যার ডেভিড হেয়ার—ইংরেজ নাট্যকার—দ্য ভারটিক্যাল আওয়ার নামে একটি নাটক লিখেছেন। যদিও নাটকটি ইরাক যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাজ্যে সাধারণ মানুষের ইরাক যুদ্ধ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত, অন্তঃস্রোত প্রসঙ্গ হিসেবে স্থান পেয়েছে ইডিপাস কমপ্লেক্স এবং ওই খোলামেলা দাম্পত্য সম্পর্ক এবং তার ফলে পুরুষ-প্রভুত্ব সমাজে নারীর চেয়ে পুরুষই যে এই খোলামেলা সম্পর্কের সুযোগটা অধিক ব্যবহার করে, তার প্রত্যয়ন। সারা যাকেরের রূপান্তরিত নাটকটির কাহিনি-আশ্রয় ঠিক এই কথাই বলেছে, যেমনটি দারিও ফো ও ফ্রানকা রামেও বলেছেন তাঁদের মূল নাটকে।
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের সনাতন রক্ষণশীল সমাজে অনেক খোলামেলা মানবীয় সম্পর্ককে উদাসীনতার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয় এবং যাকে অশ্লীলতার মোড়কে মোড়ানো হয়। ফলে বিদেশি অনেক চিরায়ত মানবিক শিল্পকর্ম সাংস্কৃতিক বিসংগতির (কালচারাল ইনকমপ্যাটিবিলিটি) দোহাইয়ে অতলে হারিয়ে যায়। এই বাধাকে সারা যাকের অতিক্রম করেছেন, দুঃসাহসে ভর করে, যার ষোলো আনা কৃতিত্ব তাঁরই। সারার রূপান্তর যেকোনো সফল নাটকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মৌলিক দুটি উপাদানকে স্পর্শ করতে পেরেছে—তার সংলাপের শব্দচয়ন দর্শকের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ সৃষ্টি করেছে এবং দুজন অভিনেতাই (নাটকটিতে দুজনই অভিনয় করেছেন) সেই সংলাপগুলো সহজভাবে প্রক্ষেপ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ রূপান্তরটির কমিউনিক্যাবিলিটি এবং স্পিক্যাবিলিটি—এই দুটি গুণই সমভাবে সমন্বিত হয়েছে।

উল্লেখ করেছি, নাটকে মাত্র দুটি চরিত্র—স্বামী ও স্ত্রী। সারা সর্ববিচারে নাটকের মূল অনুঘটক। কারণ তিনিই রূপান্তরক, পরিচালক ও স্ত্রীর চরিত্রে অভিনেতা। আমার দুটি মঞ্চায়ন দেখার সুযোগ হয়েছিল—প্রথম ও দ্বিতীয়। প্রথম প্রদর্শনীতে সারার অভিনয়ে অঙ্গ সঞ্চালনে যে একধরনের অনমনীয়তা ছিল, তা সম্পূর্ণ উধাও হয়েছে তার দ্বিতীয় মঞ্চায়নে। অর্থাৎ তাঁর সাবলীলতা ও নাটকের প্রয়োজনীয় অভিনয়কাঠামো সংরক্ষিত হতে পেরেছে। স্বামী চরিত্রে কিসলু সম্ভবত আরও একটু সচেতন হতে পারতেন, বিশেষ করে সারার সঙ্গে সঠিক যুগল হওয়ার প্রয়োজনে। নাটকে তেমন চমক লাগানোর মতো সেট ও প্রপ করার কোনো অবকাশ ছিল না এবং সে চেষ্টাও করা হয়নি—সে অর্থে সেট ও প্রপ যথাযথই ছিল। আলোর ব্যবহারও তেমন মিশ্র ছিল না—তার প্রয়োজনও ছিল না।

ওপেন কাপল নাটকটির আরও মঞ্চায়ন হওয়া আবশ্যিক। সময় এসেছে এ দেশে নারী-পুরুষ বা দাম্পত্য সম্পর্কের অন্ধকার বিষয়গুলো এখনই আলোতে আসার এবং আমরা এই সম্পর্কের এক বোঝাপড়াতে পৌঁছাই—যদিও কেউ শপথ করে কখনো বলতে পারবে না এই সম্পর্কের কোনো চূড়ান্ত স্থায়ী দিক আছে কি না। কারণ, এ সম্পর্ক মানুষে মানুষে, আর মানুষের মন তো বিচিত্র পথে সঞ্চরমাণ। তবু পুরুষ-প্রভুত্ব সমাজে দাম্পত্য জীবনে নারীর স্থানটি সঠিক চিহ্নিত হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়, বিশেষ করে সারা যাকের এক দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের নাটকটি মঞ্চে এনে। শুধু একটি প্রশ্ন: যদিও সারা তাঁর রূপান্তরে মূল নাটকের অনেক অংশ ও সংলাপ পুনঃস্থাপন করেছেন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বেশ সাহসিক কাজও করেছেন—শেষের দৃশ্যের ঘটনাটি অক্ষত না রাখার সাহস কেন করেননি জানি না। সম্ভবত এ দেশের চিরায়ত বাণীটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য: দিন শেষে পারিবারিক জীবনই জরুরি। তবু সারাকে অভিনন্দন!

আবদুস সেলিম: অনুবাদক ও নাট্যসমালোচক।