Thank you for trying Sticky AMP!!

নিয়ম-ভাঙা ছবির কবি

১৪ মে ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা মৃণাল সেনের ৯৬তম জন্মবার্ষিকী। গত বছর মৃত্যুর পর এটি ছিল তাঁর প্রথম জন্মদিন।
মৃণাল সেন। ছবি: নাসির আলী মামুন

মৃণাল সেন ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে। একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ওই সময়ে কাকরাইলের একটি নির্মাণাধীন ভবনে ছিল উৎসবের অফিস। সেখানে তাঁকে প্রথম দেখি। ডেকোরেটরের চেয়ারে আসীন ঋজু শরীর। কাশফুলের মতো সাদা চুল আর গাঢ় ফ্রেমের চশমা চোখে মৃণাল সেনের শিঙাড়া খাওয়ার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে।

মৃণাল সেনকে শেষবার দেখি কলকাতায়। তিন বছর আগে, তাঁর ভবানীপুরে পদ্মপুকুরের বাড়িতে। সেদিন হুট করেই গুজব ছড়িয়েছিল কলকাতায়, মৃণাল সেন নেই। সে খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে যাওয়া।

যতবার তাঁর বক্তব্য, আলাপচারিতা শোনা হয়েছে, মনে হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টানটা বেশ পোক্ত ছিল। কথায় কথায় বারবার ফিরে যেতেন ফরিদপুরে। পরাধীন ভারতের ফরিদপুরে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন, ১৯২৩ সালের ১৪ মে। জন্মদিন থেকে জীবনের প্রথম দিকটা কাটে ফরিদপুরের ছোট মফস্বল শহরে। মৃণাল সেনের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। তাঁর সেই স্মৃতির জানালায় কড়া নেড়ে জানা যায়, ফরিদপুর শহরের ঈশান স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা দীনেশ সেন। বয়স কম ছিল বলে প্রধান শিক্ষক মৃণাল সেনকে নিতে চাননি। পরের বছরও একই ক্লাসে ছিলেন। ঈশান থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলেন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক। তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা। দেশ ছাড়ার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর মৃণাল সেন জন্মশহর ফরিদপুরে গিয়েছিলেন।

মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জগতে আসা ১৯৫০-এর দশকে। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্য দুই মহিরুহ সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক মৃণাল সেন। তবে সত্যজিৎ রায়ের মতো শুরু থেকেই ধ্রুপদি সাহিত্য বা সাহিত্যিকের দ্বারস্থ হননি। মৃণাল সেনের শুরুটা ছিল রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবেই। দ্রোহের মেজাজ ছিল তাঁর কাজে।

বরাবরই আশাবাদী ছিলেন মৃণাল সেন। প্রথম চলচ্চিত্র রা‍ত-ভোর একেবারেই বিফল। অথচ একই সময়ে সত্যজিতের পথের পাঁচালী বিশাল সাফল্য পেল। তাতে কী? এসব মোটেও পাত্তা পায়নি মৃণালের কাছে। দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে তাঁকে ভারতে পরিচিতি এনে দেয়। আর তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান।

মৃণাল সেনের ছবির মূল বিষয় ‘দারিদ্র্য’ আর ‘শোষণ’। গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকের কলকাতা কিংবা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অনবরত উঠে এসেছে তাঁর অনেক ছবিতে। আকাশকুসুম, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, কোরাস-এর মতো সাদাকালো ছবিতে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের গল্পগুলো তুলে এনেছেন। পাশাপাশি এনেছেন নকশাল আন্দোলন থেকে বাম আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতার ইতিহাস।

এসব নিয়ে ছবির ভাবনা কীভাবে এসেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বরাবরই বলতেন ফরিদপুরের জীবনের কথা। বাবার আদর্শও বড় ভূমিকা রেখেছিল। বাবা পেশায় ছিলেন উকিল। চরমপন্থী কংগ্রেসি, বিপিন চন্দ্র পালের ঘনিষ্ঠ। ওই সময়ে বিপ্লবীদের ফাঁসির হুকুম হলে বাবা তাঁদের হয়ে মামলা লড়তেন। একবার মহাত্মা গান্ধীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল হয়। সেদিন বাবা আদালতে গেলেন না। জেলা প্রশাসক কৈফিয়ত চাইলে স্পষ্ট বলে দিলেন কারণটা। এসব ঘটনার প্রভাব পড়েছে মৃণাল সেনের কাজে।

বাংলাসহ ভারতের আটটি ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওড়িয়ায় মাটির মনিষ, তেলেগুতে ওকা উরি কথা, হিন্দিতে ভুবন সোম, এক আধুরি কাহানি, মৃগয়া, খণ্ডহর, জেনেসিস, একদিন আচানক। মূলত বাংলার প্রতিনিধিত্ব করলেও তাঁর চলচ্চিত্র ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির বোধে ঋদ্ধ। চলচ্চিত্রে ভিয়েতনাম বা লাতিন আমেরিকায় যুদ্ধের প্রামাণ্য ছবি ব্যবহার করেছেন নানা সময়ে।

মৃণাল সেন বলতেন, ‘ক্ষুধাই পারে মধ্যবিত্তকে ঘর থেকে বেরিয়ে তীব্র দ্রোহের রাজনীতির পথে টেনে আনতে।’ দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা দেখা গেছে তাঁর অনেক চলচ্চিত্রে। এ ক্ষেত্রে শুধু ১৯৪৩-এর মন্বন্তর নয়, ষাট আর সত্তরের দশকে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে যে মর্মান্তিক খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছিল, তা উঠে এসেছে বাইশে শ্রাবণ, কলকাতা ৭১, মাটির মনিষ, আকালের সন্ধানে চলচ্চিত্রগুলোতে।

নিজেই নিজের সমালোচক ছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর ভাষায়, ‘বাইরের শত্রু’ না, আমি ‘ভেতরের শত্রু’কে বেশি গুরুত্ব দিই। প্রকাশ্যে নিজের এবং নিজের দর্শনের সমালোচনাও করেছেন বারবার। যেমন বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মতান্ধতা এবং পুরুষতন্ত্রের কথা বলেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, বক্তৃতায়। চলচ্চিত্রেও এর প্রকাশ আছে। পদাতিক, একদিন প্রতিদিন চলচ্চিত্রগুলোতে বাঙালি মধ্যবিত্তের বামপন্থী ভাবনায় নারীবাদী চাবুক চালিয়েছেন নিজের মতো করে।

মৃণাল সেন এমন একজন নির্মাতা ছিলেন, যিনি সব কটি বড় চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার জয় করেছেন। ১৯৮১ সালে তিনি পদ্মভূষণ, ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্য পদে ছিলেন ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত। ফরাসি সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মানে সম্মানিত করে। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।

চলচ্চিত্র চর্চার পাশাপাশি লেখালেখিতেও নিয়মিত ছিলেন মৃণাল সেন। জনৈকের জীবনচরিত, ভিউজ অন সিনেমা, অলওয়েজ বিইং বর্ন তাঁর আলোচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সালে চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন মৃণাল সেন। বলা যায়, দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে মৃণালও খানিকটা চার্লি চ্যাপলিনের মতোই, নিয়ম-ভাঙা এক ছবির কবি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকালে জাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় এই কবির।