Thank you for trying Sticky AMP!!

বায়োপিক বললে লোকে সত্য প্রত্যাশা করত: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ডুব’ মুক্তি পাচ্ছে কাল। যৌথ প্রযোজনার এ ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হচ্ছে আজ সন্ধ্যায় কলকাতার কোয়েস্ট মল আইনস্কে। ২২ অক্টোবর সকালে বনানীর নিজের বাসায় প্রথম আলোর সঙ্গে এ চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন ‘ডুব’ ছবির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী । তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল মাহমুদ

তাহলে আপনি বলছেন বাস্তবের অনুপ্রেরণা আছে ডুব ছবিতে?

ফিকশন মেকাররা গল্প নেন তাঁর চারপাশ থেকে। গল্প আকাশ থেকে পড়ে না। আমার কাজগুলোর ক্ষেত্রেও তাই। ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, পিঁপড়াবিদ্যা—সব ক্ষেত্রে সেটাই করেছি। সব আশপাশের জীবন থেকে নেওয়া। যে চরিত্রগুলো আমাকে ভাবায়, আমি তাদের নিয়ে কাজ করি। আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি যে ডুব-এর চরিত্রগুলো আমাকে ভাবায় কি না, কষ্ট দেয় কি না। দেখলাম, গল্পের চারটি চরিত্র আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাদের জন্য আমার হৃদয় কাঁদছে, আমার পায়ের তালু গরম হয়ে উঠছে, আমি বেদনাহত হচ্ছি। যদি দেখতাম তারা আমার ঘুম হারাম করে দিচ্ছে না, আমি এ ছবি বানাতাম না।

হুমায়ূন আহমদের স্ত্রী শাওনের অভিযোগ সম্বন্ধে কী বলবেন?
মেহের আফরোজ শাওন যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, সেসব অমূলক। একটু আগেই বলেছি ফিকশন কীভাবে তৈরি হয়। তিনি বলেছেন, আমি নাকি ইতিহাস বিকৃত করেছি। জঁ লুক গদারের জীবন নিয়ে সম্প্রতি রিডাউটেবল নামে একটা সিনেমা বানানো হয়েছে। এবার কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল সেটা। ছবিটি দেখে ফ্রান্সের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি। বৃদ্ধ গদার-ভক্তরা খুব মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। কারণ, মিশেল আজানাভিসুস ছবিটাকে গদারের বায়োপিক বলছেন এবং তাঁকে কমিক্যালি প্রেজেন্ট করেছেন। মিশেল ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ছবিটা করেছেন গদারের ডিভোর্সি স্ত্রী অ্যানার ডায়েরির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু তিনি সেটার মধ্যেও নিজের ভাষ্য আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, একজন গদার তৈরি হয়েছেন নিজের কর্মের মাধ্যমে, আরেকজন গদারকে নিজের চোখে তৈরি করেছেন অ্যানা। আমি আমার নিজের গদারকে তৈরি করেছি। এটাই তো আর্ট, এটাই শিল্প, এটাই ফিকশন ন্যারেটিভ।

আপনিও আজানাভিসুসের মতো বলতেন যে এটা হুমায়ূনের বায়োপিক!
আমাদের দেশে বায়োপিক বললে লোকে সত্য প্রত্যাশা করত। আমাদের এখানে এসব বোঝার সমস্যা আছে, সেটা আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন। ফলে আমরা একে বায়োপিক বলতে চাইনি। সত্যের দায় নিতে চাইনি। কাহিনিচিত্র বানিয়েছি একটা চরিত্রকে নিয়ে।
তারপরও ধরা যাক, আমি একটা তথ্যনির্ভর জীবনী বানাব বলে ঠিক করলাম। তো সেটা কার ভাষ্য হবে? আমি যে সিনেমা বানাব, সেটা আমার ভাষ্য। আমার আশপাশের লোকজন তাতে একমত না-ও হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর প্রথম সংসার ভাঙা ও তাঁদের নতুন সংসার নিয়ে যা বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাকালে, মৃত্যুপরবর্তী সময়ে লাশ দাফন নিয়ে যা যা কাণ্ড হয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি যা যা বলবেন, সেসব তো হবে তাঁর ভাষ্য। সেটা তো হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী মানবেন না। আবার হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী যা বলবেন, সেটি কি দ্বিতীয় স্ত্রী মানবেন? তাহলে তিনি আমাকে কোন সত্য রচিতে বলিয়াছেন? তিনি বলেছেন, বায়োপিক বানালে তাঁর সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি কোন সত্য রচিব? তাঁহার সত্য?

ডুব ছবির দুটি চরিত্র জাভেদ হাসান ও সাবেরী

তিশা ছাড়া অন্য দুই নারী কেমন করেছেন?
এটা আমাদের দেশের সিনেমার জন্য আনন্দের ব্যাপার যে, আমাদের দেশের ছবি নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত সব সমালোচকেরা—হলিউড রিপোর্টার, স্ক্রিন ডেইলি—দারুণ ইতিবাচক রিভিউ লিখেছেন। সেসব জায়গায় সবার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। সবাই বলছেন, স্ট্রং কাজ, মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। আমি কৃতজ্ঞ। ছবিটার গল্প আপনার মুখের ওপর ছুড়ে মারা গল্প নয়। এটা নীরবতার ছবি, নৈঃশব্দ্যের ছবি, এটা অন্তর্মুখী বেদনার ছবি। এটা হাউমাউ করে কাঁদার ছবি নয়। এ ধরনের ছবিতে অভিনয় গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কথা এ ধরনের ছবিতে বলতে হয়—কোনো কথা না বলেই। কনটেক্সট বোঝাতে হয় সাইলেন্ট এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে। যেটা কঠিন কাজ। আমার সব অভিনেতা সেটা করেছেন।
দেশের বাইরের অনেক সমালোচক আপনাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের সমালোচকেরা আপনাকে কীভাবে নিয়েছেন?
আমি আমার দেশের সমালোচকদের দিকে তাকাই না। আমি তাকিয়ে থাকি আমাদের দেশের লাখ লাখ তরুণ দর্শকের দিকে। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ, তারাই আমাদের তৈরি করেছে। তারাই আমাদের কাছে নতুন গল্প চায়। বৃদ্ধরা নতুন কিছু গ্রহণ করতে চান না। তাঁরা শুধু অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হতে চান। তারুণ্য সব সময় নতুন রাস্তায় অন্তত একবার হেঁটে দেখতে চায়। পায়ে কাঁটা বিঁধলে আর হয়তো সেই পথে যাবে না। এই প্রজন্মের সঙ্গে আমার ১৮ বছরের পথচলা। ফর্মুলার বাইরে বানানো ছবি তারা ছাড়া আর কে দেখবে? আমাদের দেশের সমালোচকদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতিহাস খুবই দ্বন্দ্ববিধুর। তাঁরা আমাকে নানাভাবে, অন্যায্যভাবে আক্রমণ করেছেন। প্রথমে ভাষাবিকৃতির দায়ে, পরে অপেশাদার অভিনেতা নেওয়ার জন্য, পরে আবিষ্কার করেছেন, আমি লং শট কম নিই। আমি সব কটির উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছি। তাঁরা কোনোটার উত্তর দিতে পারেননি, চুপ হয়ে গেছেন।
আপনার সিনেমা হয় না, এমন কথাও শোনা গেছে।
যারা টিপিক্যাল বলিউড ছবি দেখে অভ্যস্ত, তারা বলেছে—মারপিট, ঢিসঢিস, নায়ক, ভিলেন, অ্যাকশন, ড্রামা, সাসপেন্স না হলে ছবি হয়? এই সব মনীষীর কথামতো আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মোহসেন মাখমালবাফ, রোবের ব্রেসোঁ কারোর সিনেমাই হয় না। আ সেপারেশন, টেস্ট অব চেরি, ক্লোজ আপ, দ্য সেলসম্যান কোনোটাই সিনেমা নয়, হাহাহাহা। অল্প জ্ঞান আপনাকে আসলে যেকোনো মন্তব্য করতে দুঃসাহসী করে তুলতে পারে। তবে এফডিসি ও পুরোনো বলিউড স্কুলপ্রেমী এই মানুষদের সংখ্যা এখন কমে এসেছে। এটাই আশার কথা।
আপনি যখন নতুন কিছু করবেন, তখন সবাই আপনাকে আক্রমণ করবেই। কেউ নতুন পথে গেছে আর আক্রান্ত হয়নি, এমন হয়নি। সত্যজিৎ রায়কেও প্রতি সপ্তাহে ছদ্মনামে সমালোচনার উত্তর লিখতে হতো। সমকালে জীবনানন্দ দাশের কী অবস্থা হয়েছিল? হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকান। জীবদ্দশায় তাঁকে কীভাবে নাজেহাল করেছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।

প্রচারণায় শুধু তরুণদের কাছে যাচ্ছেন কেন?
আমি সিনেমা হলের সামনে বেড়া দিয়ে রাখছি না। বলছি না যে, শুধু তরুণ দর্শকদেরই স্বাগতম। আর তারুণ্য তো মনে, বয়সে নয়। তবে প্রচারণার ক্ষেত্রে তরুণদের গুরুত্ব দেওয়ার কারণ, তারাই আমাদের সামনে এগিয়ে নেবে। আমি সম্ভাবনার দিকে তাকাতে চাই। যারা বিশ্ব সিনেমা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, নতুন কিছু দেখতে চায়, তাদের দিকে তাকাতে চাই। যাদের কোনো ফর্মুলা প্রয়োজন নেই। তারা অনেক অগ্রসর। তাদের নিয়ে আমাদের অহংকার করা উচিত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো এত অগ্রসর দর্শক আর কোথাও নেই।