Thank you for trying Sticky AMP!!

ভালো থাকিস, দোস্ত

আলী যাকের

আমাদের ছোটলু, মানে অভিনেতা আলী যাকেরের চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর থেকে আর কিছুই ভালো লাগছে না। অশ্রুও বাঁধ মানছে না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। কী শুরু হলো, সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। ছোটলুও চলে গেল।

ছোটলুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭২ সালে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক দিন মহড়া চলছে। সেখানে ছোটলু এসে হাজির। লম্বা–চওড়া একজন মানুষ। একটা মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে হাজির। সেই প্রথম দেখা।

এর আগে অবশ্য ছোটলুকে নামে চিনতাম। আমার স্ত্রী শিরিনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে ওর পূর্বপরিচয় ছিল। বিয়ের আগে শিরিনরা থাকত খুলনায়। ছোটলুর এক মামা শিরিনের ভাইয়ের সঙ্গে একটা ব্রিটিশ সার্ভে কোম্পানিতে চাকরি করতেন।

ছোটলু মাঝেমধ্যে তাঁর ওখানে যাওয়া–আসা করত। এভাবেই শিরিনের সঙ্গে সেখানে তাঁর পরিচয়। আমি ওকে শিরিনের ছোটলু ভাই হিসেবে জানতাম। ছোটলুও আমাকে শিরিনের বর হিসেবেই জানত। তবে আমাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি।

পরিচয়ের শুরুতে আমিও ওকে ছোটলু ভাই বলেই ডাকতাম। একটা সময় সুন্দর বন্ধুত্বও হয়ে গেল। কখন যে সে সম্পর্ক ভাই আর আপনি থেকে তুমি, এরপর তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে।

একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের সে কী উত্তেজনা! আমরা নাটক নিয়ে মেতে উঠেছি। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মঞ্চে এল দর্শনীর বিনিময়ে দেশের প্রথম নিয়মিত নাটক বাকী ইতিহাস। বাদল সরকারের লেখা নাটকটির নির্দেশনায় ছিল আলী যাকের। আমি প্রধান চরিত্রাভিনেতা। সে নাটকে অভিনয় করে সেরা অভিনেতার একটা পুরস্কার পেলাম। ওর পরিচালনায় আরও কয়েকটা নাটকে অভিনয় করলাম। দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করলাম দেওয়ান গাজীর কিসসায়। এই নাটকে অভিনয় করে শিল্পকলা একাডেমি থেকে দুজনে একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলাম।

এরপর আমি চাকরির সুবাদে চলে গেলাম লিবিয়াতে। কিন্তু চিঠিপত্রে আমাদের যোগাযোগ রইল। ছোটলু চিঠিতে নাগরিকের কার্যক্রম সম্পর্কে সব লিখে পাঠাত। ফিরে এসে আবার নাগরিকে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছোটলুর সঙ্গেও আবার নিয়মিত সাক্ষাৎ।

শুধু কি মঞ্চ? রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র—অভিনয় চলল সর্বত্র । আরও পরে আমি টেলিভিশনের জন্য নাটক পরিচালনায় যুক্ত হয়ে পড়লাম। আমার পরিচালনায় ছোটলু বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করল। আমি মঞ্চনাটক থেকে অনেকটা সরে এলেও ছোটলুর সঙ্গে যোগাযোগ কখনোই ছিন্ন হয়নি।

বন্ধু হিসেবে ছোটলু ছিল অনন্য। সব সময় সবার খোঁজখবর রাখত। বিপদে–আপদে বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য করত । দীর্ঘ বিরতির পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে তার সে কী উচ্ছ্বাস! সেই ছোটলু অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ অবস্থায়ও ওকে যখনই ফোন করেছি, বন্ধুত্বের সেই একই উষ্ণতা, একই উচ্ছ্বাস।

মানুষ হিসেবে ছোটলু যেমন অসাধারণ ছিল, অভিনেতা হিসেবেও। ওর জীবনের লক্ষ্য ছিল একটাই, অভিনেতা হিসেবে এমন উচ্চতায় পৌঁছানো, যাতে দেশের মানুষ তাকে চিরদিন মনে রাখে। অভিনয়কলার সে উচ্চতায় ছোটলু সত্যিই পৌঁছেছিল। মঞ্চের দেওয়ান গাজী, গ্যালিলিও, ম্যাকবেথ আর নূরলদীনকে কি কখনো ভোলা সম্ভব?

অভিনয়শিল্পী হিসেবে অসম্ভব সৃজনশীল ছিল ছোটলু। কত অনায়াসেই না চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতে পারত। চিত্রনাট্য পড়ে লেখকের ভাবনাটা বোঝার চেষ্টা করত। পরিচালকের কাছে নিজের চরিত্র জেনে–বুঝে নিত। তারপরে নামত অভিনয়ে।

আমাদের মধ্যে অভিনয়ের দারুণ এক রসায়ন ছিল। বলত, ‘তোর সঙ্গে অভিনয় করে খুব আরাম পাই।’ টেলিভিশনে একসঙ্গে বহুব্রীহি, আজ রবিবার, বটবৃক্ষ, গণিমিয়ার পাথরসহ বহু নাটকে আমরা অভিনয় করেছি।

আমাদের শেষ দেখা হলো গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে। ছোটলুর বাসায় গিয়েছিলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে সে খেলা করছিল। দেখা হতেই একই রকম উচ্ছ্বাস। এরপর কত কথা! চলে আসার সময় স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকেরকে বলল, ‘এই, হায়াতকে এখনো চা দিলে না?’ চা খেতে খেতে ফের গল্প।

ফিরে আসার সময় ছোটলুকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। শোয়া অবস্থা থেকে সে ওঠার চেষ্টা করল। কষ্ট হবে ভেবে উঠতে দিলাম না। মাথা জড়িয়ে ধরে গালটা ওর কপালে রেখে বললাম, ‘শিগগিরই সুস্থ হয়ে ওঠ। আমরা আবার একসঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করব।’ খুব খুশি হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দোস্ত, অবশ্যই।’

অভিনয় ছোটলুর সত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। জীবনে সে আর যা কিছুই করুক না কেন, অভিনয়ই ছিল সর্বাগ্রে।

ছোটলু, তুই যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস, দোস্ত।