Thank you for trying Sticky AMP!!

মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া কি আর হয়?

সামিনা চৌধুরী
৭ মে চলে গেলেন গুণী সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। তাঁকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করতেন সংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী। তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন প্রয়াত এই শিল্পীকে নিয়ে।

সংগীতের আলোগুলো একটার পর একটা নিভে যেতে শুরু করেছে। চলে গেলেন লাকী আখান্দ্, বাচ্চু (আইয়ুব বাচ্চু) ভাই, বুলবুল (আহমেদ ইমতিয়াজ) ভাই, আমার প্রিয় শাহনাজ রহমতউল্লাহ। সুবীর কাকার (সুবীর নন্দী) চলে যাওয়াটা আমার কাছে একটু বেশি বেদনাদায়ক। তাঁর বিদায়ের খবর জানার পর মনে হয়েছে, আমি দ্বিতীয়বারের মতো আমার বাবাকে হারালাম। মনে নেই শেষ কবে কেঁদেছিলাম। কাকার চলে যাওয়ার খবর শুনে কান্না আটকাতে পারিনি।

সুবীর কাকা আব্বার বয়সী শিল্পীদের পরই সংগীতাঙ্গনে এসেছিলেন। আমি যখন অনেক ছোট, তখন তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। আব্বাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমাকে মেয়ের মতো আদর করতেন। তখন থেকেই তাঁকে কাকা বলে ডাকতাম। ১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সালে বাবা একটি সিনেমায় গান করার সুযোগ পান। ছবিতে একটি গান ছিল এমন, যেখানে বাবা এবং তাঁর দুই মেয়ে গান করছে। বাবার কণ্ঠের গানটি গেয়েছিলেন সুবীর কাকা। দুই মেয়ের কণ্ঠ দিয়েছিলাম আমি আর আমার বোন ফাহমিদা নবী। ছবির নাম ছিল ফেরারী বসন্ত

সুবীর নন্দী (১৯ নভেম্বর ১৯৫৩— ৭ মে ২০১৯)। ছবি: কবির হোসেন

সুবীর কাকার সঙ্গে যখনই দেখা হতো, তিনি কিছু না কিছু টিপস দিতেন। আমি তাঁর কাছ থেকে নানা রকম টিপস নেওয়ার চেষ্টা করতাম। বটবৃক্ষের মতো তিনি আমাকে ছায়া দিতেন। এতে কিন্তু তাঁর কমত না। কথাটা বাবার কাছে শুনেছিলাম, জ্ঞান দান করলে কমে না। আমি মঞ্চে উঠলে সব সময় তাঁকে সালাম করে উঠতাম। এই কাজটা করতে খুব ভালো লাগত আমার।

কাকা ছিলেন এক জাদুকরি কণ্ঠের অধিকারী। এত মিহি, এত সুন্দর কণ্ঠ তাঁর। তাঁর ওপরে উঠতে সমস্যা হতো না, নিচে নেমে গাইতেও অসুবিধা হতো না। তাঁর ‘উড়ালপঙ্খী’ কিংবা ‘বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’ গানগুলো ভীষণ পছন্দের ছিল আমার। কেবল যে ভালো গাইতেন, তা নয়। তিনি সুরও করতেন চমৎকার, শেখাতে পারতেন আরও সুন্দর করে। শেষ যে অনুষ্ঠানটায় আমরা একসঙ্গে গাইলাম, সুবীর কাকার গলা শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর কণ্ঠে গান শুনে মনেই হচ্ছিল না যে, তাঁর কিডনিতে ডায়ালাইসিস চলছে। বোঝা যাচ্ছিল না যে তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা আছে। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে তাঁর মতো এক শিল্পীর চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের প্রস্থানও আমার কাছে মেনে নেওয়ার মতো ছিল না। আমার মনে হয়েছে তাঁর প্রস্থানে যেন গানই থেমে গেছে, বিশেষ করে দেশের গান। আরও বলতে হয় শাহনাজ রহমতউল্লাহ কথা। তাঁর যে গায়কি, সে রকম আর কেউ আসবে না।

১৯৮৪ সালে আমি আর সুবীর কাকা কলকাতায় গিয়েছিলাম। গীতিকার আবিদুর রহমানের লেখা, বাংলাদেশের সমর দাস এবং কলকাতার প্রবীর মজুমদারের সুরে আমরা একটা অ্যালবাম করি। আমাদের গান শুনে কলকাতার লোকেরা বিস্মিত হয়ে যায়। সুবীর কাকা আমাকে মাহমুদুন্নবীর মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, সে হয়তো অনেক ছোট কিন্তু আমাদের দেশের একটি ব্যতিক্রম কণ্ঠস্বর। সে একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।

কাকার সঙ্গে শেষ কথা হয় গত স্বাধীনতা দিবসে, বঙ্গভবনে। সেখানে খুব সতেজ লাগছিল তাঁকে। অনেকক্ষণ গল্প হলো, আড্ডা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি এত সুন্দর গাইলেন যে শুনে বোঝাই যাচ্ছিল না তাঁর বয়স ৬৫ বছর। মনে হচ্ছিল ৪০। সেদিন তিনি কিছু দুঃখের কথা বললেন। আমাকে তিনি সুমা বলে ডাকতেন। বললেন, ‘সুমা’, ‘বাংলাদেশের গানের মান কমে যাচ্ছে। এখনকার গানে তেমন প্রাণ নেই।’ আবার বললেন, ‘আমার গলাটা ব্যবহার করার মতো সুর নেই। গলাটা নিয়ে খেলতে পারব, এমন সুর করছেন না কেউ।’ প্রশংসাও করেছেন কারও কারও। বললেন, দু-একটা ছেলে-মেয়ে খুব ভালো করছে। আমাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘যখন যেখানে গান গাইতে ডাকবে, গাইবে। আমার হাতে তো আর বেশি দিন সময় নেই। যত দিন পারা যায় আমিও গাইব।’ আমাকে গজল শুনতে বলতেন। বলতেন, ‘তুমি ভালো গজল গাও। সব জায়গায় গজল গাইবে।’ চ্যানেল আইয়ের আজীবন সম্মাননার অনুষ্ঠান হয়েছিল সিলেটে। তিনি বলছিলেন, ‘আবার কবে যে সিলেটে আসতে পারি কে জানে!’

সুবীর নন্দীর মতো গানের নক্ষত্র ঝরে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর গান, তাঁর শিখিয়ে যাওয়া কৌশলগুলো আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে আজীবন। তিনি যে আমাদের ভালোবাসতেন, সেটা যে আমাদের জন্য কত বড় পাওয়া, সেটা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। তিনি যেখানেই থাকেন যেন ভালো থাকেন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে তাঁর যত ভক্ত আছে, তাঁর কি আর কোথাও যেতে হয়? তিনি যেখানেই যান না কেন, ভক্তদের হৃদয়ের আসনে তিনি সব সময়ই থাকবেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় এরপরেই হয়তো আমাদের পালা।

একটা ঘটনা আমাকে অবাক করেছে। শাহনাজ চাচীর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো অনুষ্ঠান বা লেখালেখি হয়নি। আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি চলে গেলেও হয়তো কোনো অনুষ্ঠান বা লেখালেখি হবে না। যত দিন পারা যায়, গান করে যাব।

সুবীর কাকারও হয়তো কোনো আশা ছিল না। তবে তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অনেক। এর চেয়ে বড় পাওয়া কি আর হয়?