Thank you for trying Sticky AMP!!

আজ ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবস

ছবিতে আরেকবার সত্যজিৎ রায়

দাদার শূন্য কাজের ঘর থেকে একটি কাঠের বাক্স পেয়েছিল ছেলেটি। সেখানে থাকত দাদার রং, তুলি আর তেল রঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড অয়েলের শিশি। উত্তরাধিকারের সেই ধারা পরবর্তীকালে প্রজন্মজয়ী হয়েছিল ছেলেটির হাত ধরেই। মায়ের আদরের সেই ছেলেটির প্রথমে যা রাখা হয়েছিল, পছন্দ হয়নি নবজাতকের বাবার। পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হয় ‘সত্যজিৎ’। তিনি প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও সুপ্রভা রায়ের সন্তান। দাদা ছিলেন সে যুগের এক প্রতিভাবান শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ২ মে ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া এ মানুষটির জাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। আজ প্রয়াণ দিবসে ফেসবুক থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ছবিতে আরেকবার জেনে নিই সত্যজিৎ রায়কে।

তাঁর ডাকনাম ছিল মানিক। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে পৈতৃক নিবাস হলেও ১৯২১ সালের ২ মে প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও সুপ্রভা দেবীর কোল আলো করে  উত্তর কলকাতায় জন্ম নেন সত্যজিৎ।
পাঁচ বছর বয়সে সত্যজিৎ গড়পার ছেড়ে চলে আসেন ভবানীপুরের বকুল বাগানে। ৯ বছর বয়সে ভর্তি হন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। পরে ইকোনমিকস নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কিছুদিন শান্তিনিকেতনে কলাভবনে শিক্ষা নেন
১৯৪৩ সালে তিনি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বিজ্ঞাপন সংস্থায় যোগ দেন। শুরুতে তাঁর বেতন ছিল ৮০ টাকা। বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার জগতে গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অন্য এক মাত্রা যোগ করে। এই পেশায় থাকার সময় 'পথের পাঁচালী'র ছোটদের সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু'র প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে তিনি ‘পথের পাঁচালী’কে চিত্রায়িত করার সিদ্ধান্ত নেন
ঘটনাচক্রে একই বছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত পুরোপুরিভাবে এক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু করেন সত্যজিৎ। তবে ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পরই বোধ হয় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন
১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি
তাঁর পরের দুটি ছবি ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘পথের পাঁচালী’—এ তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে অপু ট্রিলজি হিসেবেই পরিচিত। ‘অপরাজিত’ ছবির সাফল্য সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে
তারপর একের পর এক চলচ্চিত্র তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘তিন কন্যা’, ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চারুলতা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘নায়ক’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ প্রভৃতি ২৭টি কাহিনিচিত্র।
বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ প্রেমচাঁদের গল্পের ওপর ভিত্তি করে হিন্দি ভাষায় এক ঘণ্টার একটি ছবি বানিয়েছিলেন ‘সদ্গতি’ নামের
১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাঁকে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন প্রদান করে। মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন
চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ণ, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনি লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক
১৯৮৩ সালে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। এরপর তাঁর কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। এই ছবিতেই সত্যজিৎ প্রথমবারের মতো একটি চুম্বন-দৃশ্য যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন
১৯৯২ সালে হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা নিয়ে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তাঁর। ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন