Thank you for trying Sticky AMP!!

সব কটা জানালা খুলে দাও

রোমান হলিডে ছবির পোস্টারে অড্রে হেপবার্ন ও গ্রেগরি পেক
ভয়ানক হারে কমছে প্রেক্ষাগৃহ। সিনেমাও নির্মিত হচ্ছে খুব কম। প্রযোজকেরা এ শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। বিদেশি সিনেমা ও টিভি ধারাবাহিক প্রদর্শন নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। এর মধ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি আগামী ১২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ একসময় বাংলা সিনেমার কী সুদিনই না ছিল! এসব নিয়ে লিখেছেন মতিউর রহমান

১৯৫৬ সাল, তখন আমি পুরান ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবন কেটেছে বংশাল রোডে। মনে পড়ে, ১৯৫৬ সালে আমাদের আজিজ কাকা এক রোববার সকালে বড় দুই ভাই প্রয়াত প্রকৌশলী লুৎফর রহমান, ড. রেজাউর রহমান ও আমাকেসহ তিনজনকে নিয়ে যান লায়ন সিনেমা হলে মর্নিং শোতে ছবি দেখতে। মনে আছে, চারজন হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম লায়ন সিনেমা হলে। সিনেমাটি ছিল গ্রেগরি পেক-অড্রে হেপবার্নের সেই বিখ্যাত ছবি রোমান হলিডে। সেই স্মৃতি আজও মনে উজ্জ্বল।

রোমান হলিডে ছবিতে অড্রে হেপবার্ন ও গ্রেগরি পেক

এরপরের শুক্রবারের ম্যাটিনি শোতে দেখেছিলাম গুলিস্তান সিনেমা হলে উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত সবার উপরে। তখন থেকেই ঢাকা শহরে আমার সিনেমা দেখা শুরু। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হলে নিয়মিত সিনেমা দেখেছি। কলকাতা, লাহোর, করাচি ও মুম্বাইয়ের সিনেমা এবং হলিউডের সব সেরা সিনেমা—অস্কারজয়ী প্রায় সব চলচ্চিত্র অতি দ্রুত আমরা ঢাকার হলগুলোতে দেখতে পেতাম। এসবের বাইরে রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্সের সিনেমাও দেখতাম। গত ৫০ বছর ধরেই নানাভাবে সেই সব সিনেমার কথা খুব বেশি মনে পড়ে।

তখন গুলিস্তানসহ অন্য হলগুলোতে মর্নিং শো চলত ইংরেজি সিনেমা নিয়ে। গুলিস্তান সিনেমা হলের ওপরের তিনতলায় ছিল নাজ সিনেমা হল। সেখানে সারা বছর শুধু ইংরেজি বা বিদেশি সিনেমা চলত। এখন ভাবতে অবাক লাগে, পুরান ঢাকার নিশাত, লায়ন, মুকুল হলেও মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো।

আইল্যান্ড ইন দ্য সান ছবিতে হ্যারি বেলাফন্টে ও জোয়ান ফন্টেইন

আমি ১৯৫৮ সালের কোনো এক রোববারের সকালে মুকুল হলে গিয়ে দেখেছিলাম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা ও গায়ক হ্যারি বেলাফন্টের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ অভিনেত্রী জোয়ান ফনটেইনের অভিনীত প্রথম ছবি আইল্যান্ড ইন দ্য সান। এই সিনেমা নিয়ে সে সময় আমেরিকায় অনেক বিতর্ক হয়েছিল। পরে বেলাফন্টের আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি, এই সিনেমাকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় অনেক হল ভাঙচুরের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছিল। তারপর থেকে বেলাফন্টে আমার প্রিয় হিরো।

১৯৬১ সালে মুক্তি পায় ঢাকায় তৈরি ফতেহ লোহানী পরিচালিত আসিয়া (প্রথম সবাক বাংলা ছবি মুখ ও মুখোশ)। চোখে অনেক বিস্ময় নিয়ে দেখেছিলাম সেই ছবি। তবে তার আগেই ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই মুক্তি পেয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় ছবি আকাশ আর মাটি। সে বছরের ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে মুক্তি পায় এহতেশামের এ দেশ তোমার আমার। নায়ক ছিলেন খান আতাউর রহমান। সংগীত পরিচালকও তিনি। এর পরপরই ১৯৬১ সালে একক সিনেমা পরিচালক হিসেবে আবির্ভাব হয় জহির রায়হানের। তাঁর কখনো আসেনি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন খান আতা ও সুমিতা দেবী। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকসহ নয়টি পুরস্কার পেয়েছিল। আরও একটি গৌরব ছিল যে ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা সঙ্গম তৈরি করেছিলেন। দারুণ সফল হয়েছিল। তারপর থেমে থাকতে হয়নি ঢাকার চলচ্চিত্রকে। এভাবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা তৈরি করেছিলেন ঢাকার চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা।

সবার উপরে ছবিতে সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও লাহোর, করাচি বা হলিউডের, ইতালীয়, রুশ সিনেমা এখানে চলেছে। বিদেশি সেরা ছবিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্যেও সে সময় ঢাকার অনেক বাংলা ও উর্দু সিনেমা বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছিল।

গ্রেগরি পেক, কার্ক ডগলাস, পিটার ও’টুল, কেরি গ্র্যান্ট, রক হাডসন, এলিজাবেথ টেইলর, সোফিয়া লরেন, সুসান হেওয়ার্ড, মেলিনা মারকুরির সিনেমার পাশাপাশি সেই দিনগুলোতে দেখেছি সুচিত্রা, উত্তম, সুপ্রিয়া, অনিল চ্যাটার্জি, মুম্বাইয়ের দিলিপ কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, নার্গিস, মধুবালা, ওয়াহিদা রেহমান প্রমুখের সিনেমা। সেই সময়কার নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী—আমার যাঁদের কথা এখনো কিংবদন্তির মতো মনে পড়ে—ফতেহ লোহানী, সুমিতা, খান আতা, সুভাষ দত্ত, রাজ্জাক, সুচন্দা, ববিতা, কবরী, আনোয়ার হোসেন, শবনম, রোজী, শওকত আকবর প্রমুখ।

১৯৭০ সালে আমরা হলে গিয়ে দেখেছি জহির রায়হানের সিনেমা জীবন থেকে নেয়া। দেখে উদ্দীপ্ত হয়েছি। জহির রায়হানের সঙ্গে পরিচয় ছিল বলে ছবির শুটিংও দেখেছিলাম এফডিসিতে। সেই সিনেমায় দেখেছি কীভাবে বাংলা সিনেমা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ভালো নির্দেশনার দৃষ্টান্ত হতে পারে। পাশাপাশি তখন যে বাংলাদেশে জাতীয় জাগরণ চলছিল—গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এবং একই সঙ্গে স্বাধিকারের দাবিতে—এই বিষয়গুলোর সামগ্রিক রূপ পাওয়া গিয়েছিল সেই সিনেমার মধ্য দিয়ে।

এটা আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়, তখন বিদেশি সেরা সিনেমার অবাধ প্রদর্শনীর মধ্যেই দেশীয় কলাকুশলীরা প্রতিযোগিতা করে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁরা দুনিয়ার সেরা কাজগুলো দেখেছেন, শিখেছেন এবং দর্শকের রুচি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। সেভাবেই নিজেদের তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং ক্রমেই আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন।

স্বাধীনতার পর এই প্রথম আমাদের একধরনের নতুন কথা শোনার অভিজ্ঞতা হলো, বিদেশি সিনেমা আমরা দেখতে চাই না। ভারতীয়সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সিনেমার প্রদর্শনীও বন্ধ। এই সিদ্ধান্ত এখনো রয়েছে। কিছুদিন আগেও দাবি উঠেছিল, বিদেশি ধারাবাহিক টিভিতে দেখানো যাবে না। কী সর্বনাশা এসব দাবি!

বিদেশি বই কিন্তু আমরা আমদানি করছি। আমরা কি এখন এ দাবিও তুলব যে আমরা ভারতীয়, ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষার সাহিত্য-বিজ্ঞানের বই দেশে ঢুকতে দেব না? আমাদের লেখকেরা কি তেমন দাবি তুলেছেন যে বিদেশি বই আমদানি করা বন্ধ করতে হবে? না হলে তো তাঁদের বই বিক্রি হবে না? তাঁরা তা তোলেননি। কারণ তাঁরা সারা বিশ্বের সব ধরনের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং সেগুলো পড়ে ও আত্মস্থ করেই নিজেদের সমৃদ্ধ করছেন এবং সৃজনশীল লেখা লিখে যাচ্ছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন।

জীবন থেকে নেয়া ছবিতে রাজ্জাক ও সুচন্দা

যদি বিটিভির স্বর্ণযুগের কথা বলি, দেখব আশি ও নব্বইয়ের দশকে হারকিউলিস, অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদ, আলিফ লায়লা, মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড, টারজান, মিস্টার বিন, রোবোকপ, রবিনহুড, নাইট রাইডার, দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান, আকবর দ্য গ্রেট প্রভৃতি বিদেশি বিখ্যাত ধারাবাহিকগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, অয়োময়, এইসব দিনরাত্রি, সংশপ্তক, শুকতারা, বহুব্রীহি, নক্ষত্রের রাত প্রভৃতি ধারাবাহিক নাটকও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। সেগুলো এখনো জনপ্রিয়। এখনো দেশ-বিদেশের বাঙালিরা দেখেন। আমরা শুনেছি, তখন আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের ভারতীয় সীমান্ত এলাকার লোকজন বিটিভির নাটকগুলো দেখতেন।
এসব কিছু দেখে এবং জেনেবুঝেও আমরা কি বিশ্বের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে নিজেদের ঘরে বন্দী হয়ে বসে থাকব? তা দিয়ে আমাদের সাহিত্য, শিল্পকলা, নাটক, সিনেমায় কি উন্নতি ঘটবে? আমাদের কথা হলো, সারা বিশ্বের সিনেমা ও নাটকের দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশ আজ যেসব ইতিবাচক জায়গায় পৌঁছেছে, তার ভিত্তি রচিত হয়েছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে—যখন আমরা সবকিছু পড়তে পেরেছি, সবকিছু দেখতে পেরেছি। আমাদের কথা হলো, যিনি যা কিছু ভালো দেখতে চান, জানতে চান, তাঁর সবকিছুই তাঁকে দেখতে দিতে হবে। সেখানে কেউ কাউকে দরজা বন্ধ করে দিতে পারবেন না। কারণ, তা না হলে তাঁরা নতুন পথ সন্ধান করবেন। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, ফেসবুকসহ কোনো না কোনো মাধ্যমে তাঁরা অবশ্যই দেখবেন সবকিছু। তাহলে বিদেশি সিনেমা, সিরিয়াল বা নাটক বন্ধ করে বাংলাদেশে সংস্কৃতি বা বিনোদন জগতের কী লাভ?

এটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, বর্তমান বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকতে পারে না। তাই আমাদের ভালো সিনেমা তৈরি করতে হবে, ভালো নাটক তৈরি করতে হবে। একটা কথা উঠেছে বিনিয়োগ নিয়ে। আমাদের বক্তব্য, যাঁরা এ বিষয়ে বিনিয়োগ করবেন, তাঁরা ভালো কিছুর জন্য করবেন, ব্যবসা থেকে মুনাফা করতেই বিনিয়োগ করবেন। ভালো কিছু করতে চাইলে তো বিনিয়োগ করতেই হবে। আর সেটার জন্য আমাদের সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

বিদেশি সিনেমা ও টিভি সিরিজ বন্ধ করে দিলেই কি যে ধরনের সিনেমা ও নাটক বানানো হচ্ছে, সেগুলো মানুষ দেখতে থাকবেন? মানুষ তো সেগুলো দেখছেন না। জনপ্রিয় হচ্ছে না। বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আসছে না। এ ক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যার সমাধানে না গিয়ে কেন অন্য উল্টো পথে সমাধানের কথা ভাবতে হবে?

আমরা জানি, আমাদের ক্রিকেটাররা বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নিতে যান। নিয়মিত বাইরের দেশের অভ্যন্তরীণ টুর্নামেন্টে খেলতে যান। বাইরের দেশের ক্রিকেটাররা আমাদের বিপিএলসহ অভ্যন্তরীণ টুর্নামেন্টে এবং ক্লাবগুলোতে নিয়মিত খেলতে আসেন। বাইরের দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকে বলে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা ভালো করছেন। বাইরের দেশের খেলোয়াড়েরা আমাদের দেশে খেলতে আসেন বলেই তো এসব ক্ষেত্রে ভালো করছি আমরা। কেউ কি প্রশ্ন তোলেন, বাইরের দেশের খেলোয়াড় খেললে আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের ভাগে টাকা কম পড়ে যাবে? তাই বিদেশি খেলোয়াড় খেলানো যাবে না? সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে?

সারা বিশ্বের ছবির জন্য আমাদের প্রেক্ষাগৃহগুলো উন্মুক্ত হোক। এই আবদ্ধ বাজার থেকে মুক্তি চাইতে গিয়ে একটি দেশের একটি ভাষার ছবির মধ্যেই যেন আমাদের বাজার আবার আবদ্ধ হয়ে না পড়ে। মুক্তি মানে সার্বিক মুক্তি।

আসলে দরজা বন্ধ করে লাভ হয় না। ক্ষতি হয়। দিন দিন আমাদের ক্ষতিই শুধু বাড়ছে। কোনো লাভ হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমরা কি একই অন্ধ-বন্ধ পথে চলতে থাকব?

লেখক: সম্পাদক, প্রথম আলো