Thank you for trying Sticky AMP!!

স্তালিনকে দেখলাম

স্তালিন নাটকের দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা

নাটকই দেখতে গেছি, অন্য কিছু নয়। মোটেও ভাবিনি, সোভিয়েত ইতিহাসের জ্বলজ্যান্ত সত্য ঘটনাগুলো ভেসে উঠবে চোখের সামনে। মনে ছিল আশা, স্তালিনের সময়টা উঠে আসবে তাঁর সমস্ত নির্মমতা এবং প্রগলভতা নিয়ে। স্তালিন চরিত্রের ভালো–মন্দ কিছু দিক আছে, উঠে আসবে সেগুলো। আমার ১০ বছরের সোভিয়েত জীবনে ধীরে ধীরে যখন বেরিয়া, ঝ্দানভ (নাটকে ছিলেন না), মলোতোভদের হিংস্রতার খবর শুনছিলাম সেই আশির দশকের মাঝামাঝি, ভেবেছি, সেটাই দেখতে পাব মঞ্চে।

কিন্তু যে স্তালিনকে দেখলাম নাটকে আগাগোড়া চিৎকাররত, তাঁর সঙ্গে সোভিয়েত লৌহমানব স্তালিনের সাদৃশ্য পেলাম কমই। আমরা বিভিন্ন লেখায় যেভাবে পড়েছি, বিভিন্ন তথ্যচিত্রে যেভাবে দেখেছি তাঁকে, তাতে আর যা–ই হোক, তাঁকে ও তাঁর পারিষদদের (পলিটব্যুরোর সদস্য) ক্লাউন বলে মনে হয়নি কখনো। বরং ঠান্ডা মাথার খুনি বলেই মনে হয়েছে—কী নির্মম রসিকতা করেছেন তাঁরা বুখারিন বা মেয়ারহোল্ডদের জীবন নিয়ে, সে কথাগুলোই ভেবেছি বারবার। সমাজতন্ত্র বাঁচাতে ‘গণশত্রু’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদী কিংবা বিরুদ্ধ মত আছে যাঁদের, নিষ্ঠুরভাবে তাঁদের হত্যা করার সেই করুণ কাহিনি আজও রাশিয়াকে রক্তাক্ত করে।

নাটক সম্পর্কে আমাদের গতানুগতিক ভাবনা ভেঙে দিয়ে নির্দেশক একটা এমন ফর্মের মধ্যে আমাদের নিয়ে যান, যাতে ঢুকতে একটু কষ্ট হয়। প্রচলিত ধরন নয় বলেই হয়তো রসিকতার আড়ালে শ্লেষ আর নৃশংসতাটুকু থাকে। একজন মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়েই চারদিকে গণশত্রু দেখতে পান, নিজ দলের মানুষ ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করেন না, এরপর নিজ দলের লোকজনকেও বিশ্বাস করেন না, বিশ্বাস করেন না পলিটব্যুরোর সদস্যদের, এমনকি একসময় নিজেকেও অবিশ্বাস করতে শুরু করেন।

সোভিয়েত যুগে গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর যে রক্ত শীতল করে দেওয়া কার্যক্রম ছিল, তা ফুটিয়ে তুলছিলেন কুশীলবেরা। সাধারণ মানুষকে শ্রেণিশত্রু নাম দিয়ে যেমন খতম করা হয়েছে, তেমনি শিল্পী, সাহিত্যিকদেরও কতল করা হয়েছে নির্বিচারে। স্তালিনের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর থেকেই ব্যক্তিপূজার বিষয়গুলো বেরিয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে আরও অনেক অনেক নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে। শুধু সে দেশটিই নয়, বামপন্থায় বিশ্বাসী সারা বিশ্বের মানুষ তাতে আহত হন, মর্মাহত হন। তারই শুরু হয়েছিল ওই স্তালিন–যুগে।

স্তালিন সম্পর্কে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতে দুই রকম মূল্যায়ন রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ তাঁর আমলের নৃশংসতায় শিহরিত হলেও এমনও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন, সে সময় সমাজতন্ত্র গড়ার জন্য স্তালিনের মতো লৌহমানবেরই দরকার ছিল। তবে নির্বাসন ও হত্যার যে অমানবিকতার মধ্যে বসবাস করছিল সোভিয়েত জনগণ, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

চমক ছিল মিলনায়তনে ঢোকার শুরুতেই। সেখানেই শুরু হয়ে যায় নাটক। এরপর মিলনায়তনে ঢুকেই সের্গেই আইজেনস্টাইনের ইভান গ্রোজনি (ইভান দ্য টেরিবল) চলচ্চিত্রের কিছু অংশ দেখার পর বন্দুকের নলের সামনে চলচ্চিত্রকারকে দেখতে পাই এবং শুনতে পাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার বা সিএটিকে এ কারণেই ভালো লাগে যে, নাটকের মাধ্যমে যেকোনো সময়ই বিশ্বাসযোগ্য একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে তারা।

যে কুশীলবেরা দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অভিনয় করে গেলেন, যাঁরা থাকলেন শব্দযন্ত্র আর আলো নিয়ন্ত্রণে, তাঁদের কুশলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। স্তালিন চরিত্রে শাহাদাত হোসেন কিন্তু অভিনয় খারাপ করেননি। কিন্তু যে কাহিনিটি নিয়ে এগিয়েছেন কামালউদ্দিন নীলু, তার দৈর্ঘ্য কি আর একটু কম হতে পারত না?

নাটক দেখে মনে হলো, স্তালিনের মাধ্যমে গোটা মার্ক্সবাদী আচরণকেই যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন নাট্যকার। সোভিয়েত ভুলকে ছাড়িয়ে মার্ক্সবাদ যে নতুন ব্যাখ্যার পথে এগিয়েছে, সেখানেও নির্ভরতা পাওয়া যেতে পারে—এ কথা যাঁরা মানেন, তাঁরা নাটক দেখে হোঁচট খাবেন।

একটা কথা না বললেই নয়, সবচেয়ে কানে লেগেছে ‘লেলিন’ শব্দটি! সতেরোর বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানোভকে (লেনিন) ‘লেলিন’ বলে ডাকা হলে সত্যিই হোঁচট খেতে হয়।

আরেকটা কথা, নাটকজুড়ে তথ্যের পর তথ্য জোগাড় করা হয়েছে ইটের মতো। কিন্তু তা থেকে কোনো ইমারত শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠল কই?