Thank you for trying Sticky AMP!!

'রক্তক্ষরণ বন্ধ হলে শিল্পী থাকে না'

বেঙ্গল শিল্পালয়ে এক আয়োজনে মুর্তজা বশীরকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন শিল্পী রফিকুন নবী। পাশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান l ছবি: কবির হোসেন

‘কিছুদিন আগে অবরোধের সময় আমি মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। আমার লাশ বহনের জন্য লাল পতাকা বাঁধা গাড়িও আনা হয়েছিল। কিন্তু আমি মরতে চাইনি। কারণ, এত দিন ধরে আমি কেবল গ্রামার শিখেছি। কাজ তো কিছুই করিনি। এরপরে করতে হবে’—৮৩তম জন্মদিনে, ৮৪তম বছরের প্রথম দিনটিতে বলছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর (জন্ম ১৯৩২)। গতকাল সোমবার শরতের প্রসন্ন সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে বেঙ্গল আয়োজিত শিল্পীর জন্মদিনের ‘ঘরোয়া’ আসরে বললেন এই শিল্পী।
জন্মদিনের আয়োজনে তাঁর সম্মতি ছিল না, শেষে শর্তসাপেক্ষে রাজি হয়েছেন, শর্ত হলো—গণমাধ্যমকে জানানো যাবে না, আর তাঁকে বসিয়ে রেখে গান করা চলবে না। তবুও শিল্পীর প্রতি ভালোবাসার টানে সন্ধ্যাটা হয়ে উঠেছিল জমজমাট। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সভাপতির ভাষণে বললেন, ‘মুর্তজা বশীর বহুমুখী প্রতিভা, তিনি চিত্রশিল্পী, তৈলিচিত্র, জলরং, কালি-কলমের কাজ, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, লিথোগ্রাফ করেছেন, মোজেক ও ম্যুরাল তাঁর প্রিয় মাধ্যম, গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন ছায়াছবির চিত্রনাট্য, ছিলেন সিনেমার সহকারী পরিচালক এবং তিনি মুদ্রাতত্ত্ববিশারদ।’ মুর্তজা বশীরের কীর্তিমান পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও তাঁর শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, উভয়ের মৃত্যুর পরই তিনি খুব শ্রদ্ধাপূর্ণ সুন্দর লেখা প্রকাশ করেন।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, স্কুলজীবনে মুর্তজা বশীরকে তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে, আর ১৯৫৬ সালে প্রেসক্লাবে দেখতে গিয়েছিলেন মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরের চিত্রপ্রদর্শনী। তিনি জানান, মুর্তজা বশীর কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। অংশ নিয়েছেন ভাষা আন্দোলনে, শহীদ বরকতের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধারে এগিয়ে গিয়েছিলেন, বরকতের রক্তমাখা রুমাল তাঁর সংগ্রহে ছিল, তিনি ১৯৫২ সালে প্রথম শহীদ মিনার গড়তে দেখেছেন, তারপরের দিন তা ভাঙতে দেখেছেন, তা আবার গড়ে উঠতে দেখেছেন। মতিউর রহমান বলেন, আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী-লেখকেরা—আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে মুর্তজা বশীর—সবাই ৫২-এর সন্তান এবং সেই ৫২-এর পথ বেয়েই ষাটের দশক, মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তীকালে গণতন্ত্র ও মানবতার জন্য পথচলা। মতিউর রহমান কবি মুর্তজা বশীরের দুটো কবিতা পাঠ করে শোনান।
শিল্প সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ মুর্তজা বশীরকে পিকাসোর মতোই বহুমাত্রিক মাধ্যমের শিল্পী হিসেবে অভিহিত করে বলেন, শিল্পীর স্বচ্ছ কিউবিজম কিংবা বাস্তবতাবাদী বিমূর্ততার মূল্যায়ন হয়নি, কারণ একই মঞ্চে এসব কাজ তুলে কোনো পূর্ণ সমালোচনার আয়োজন করা যায়নি। লোক, প্রাচ্য, পাল, বাইজেন্টাইন প্রমুখ রীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত তিনি, তাঁর হাতে আছে কলম, তুলি আর একটা আতশ কাচ। আতশ কাচ দিয়ে যেমন তিনি প্রজাপতির পাখাকে বড় করে দেখেছেন, তেমনি মুদ্রার গুপ্তলিপি পাঠ করেছেন।
শিল্পীর বন্ধু সৈয়দ জাহাঙ্গীর মুর্তজা বশীরকে নিয়ে নানা বাল্যস্মৃতি রোমন্থন করেন।
মুর্তজা বশীর বলেন, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হলে শিল্পী আর শিল্পী থাকে না। আমি এখন যখন কাজ করি, তখন আমি প্রাণমন ঢেলে দিয়ে কাজ করি। আমার মনে হয়, হয়তো এটিই আমার শেষ কাজ। তিনি বলেন, মৃত্যুর পরে যদি আমাকে মনে রাখা হয়, তাহলে তা হবে আসল ভালোবাসা।
অনুষ্ঠানে শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, রফিকুন নবী, হাসনাত আবদুল হাই, মুনতাসীর মামুন, মনিরুল ইসলাম (তাঁরও ছিল কাল জন্মদিন) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, মাহবুব তালুকদার, বীরেন সোম, শামসুজ্জামান খান, আবুল খায়ের, আবুল বারক আলভী, আবুল হাসনাতসহ অনেক গণ্যমান্য শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। অনেকের হাতেই ছিল ফুলের স্তবক। অনুষ্ঠানের ভিড়ের মধ্যেই একসময় একলা পেয়ে তাঁকে আমি জিগ্যেস করি, কত বছর বাঁচতে চান? তিনি বলেন, আগে বলতাম ৯২ বছর, পিকাসোর চেয়ে এক বছর বেশি, এখন আর সেটা বলতে চাই না, আমার আগে আমার প্রিয়জনেরা চলে যাক, এটা আমি চাই না। তিনি বলেন, আমি আমার ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থের জন্য বেঁচে থাকব, কারণ এতে আমি ইতিহাসবিদদের বাইরে নতুন কথা বলেছি।
আমি বলি, আপনি আপনার অনবদ্য চিত্রকলার জন্যও বেঁচে থাকবেন হাজার বছর।
সন্ধ্যার আলো নিভে আসে, রাত্রি গাঢ় হয়, বেঙ্গলের ক্যাফেতে শিল্পীকে ঘিরে আড্ডা চলতেই থাকে।