Thank you for trying Sticky AMP!!

'স্যান্ডউইচ' থেকে 'নো ল্যান্ডস ম্যান'

বনানীতে নিজের বাসায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ছবি: আবদুস সালাম

ঠিক কবে থেকে জন্ম নিতে শুরু করল ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’, সেই খোঁজ দিতে পারলেন না স্বয়ং পরিচালকও। মাঝেমধ্যে তাঁর মনে হয়, গল্পটা সব সময় তাঁর সঙ্গেই ছিল। কারণ, এই ছবির মূল বিষয় ‘পরিচয়’। হয়তো অবচেতনভাবেই নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভেতরে উঁকি দিয়েছিল, বাসা বেঁধেছিল ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’। তারপর ২০১০ সালে একটা খসড়া লিখলেন বটে, তখন এর নাম ছিল ‘স্যান্ডউইচ’। তারপর এই গল্পকে শেলফে রেখে ফাঁকে শেষ করলেন ‘টেলিভিশন’। তারপর ২০১৪ সালে আরেক দফায় লেখা হলো সেই চিত্রনাট্য। তখনই গল্পের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল এর নাম। এই নির্মাতার ভাষায়, ‘যেভাবে আমার চুল পড়ে, দাড়ি পাকে, নখ বড় হয়, চিত্রনাট্যও সময়ের সঙ্গে একইভাবে বদলে যায়, পরিণত হয়। নতুন নাম “নো ল্যান্ডস ম্যান” নিয়েই এটা যাত্রা শুরু করল বুসানের প্রজেক্ট মার্কেটে। জিতল মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশন আর অ্যাপসার ফিল্ম ফান্ড। গোয়া ফিল্ম বাজারের বেস্ট প্রজেক্ট হিসেবে নির্বাচিত হলো।

নওয়াজুদ্দিন যেভাবে উঠলেন ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এর নৌকায়
প্রথমে এই ছবির মূল চরিত্রে অন্য জনপ্রিয় একজন ইরানি অভিনেতাকে ভেবেছিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ২০১৪ সালের কথা। এক বন্ধুর মাধ্যমে এই নির্মাতা সেবার মুম্বাইয়ে ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘স্যাকরেড গেমস’খ্যাত নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর অফিসে গেলেন আডডা দিতে। সেদিন ফারুকী এই ছবির গল্প শুনিয়েছিলেন গুণী এই ভারতীয় অভিনেতাকে। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী যতই শুনছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল তাঁর চোখ, এক্সপ্রেশন। তিনি যেন গল্পের সেই চরিত্র। তারপর যখন গল্প শেষ হলো, তখন নির্মাতা আর অভিনেতা দুজনেরই চোখে পানি। শিশুর মতন হাততালি দিয়ে উঠলেনন ওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। সেদিন ফারুকী কেবল বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমার ছবির জন্য তুমিই সঠিক ব্যক্তি।’ নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয়সত্তাও বোধ হয় এ রকম একটা বৈচিত্র্যময় জটিল মানবচরিত্রের জন্য মুখিয়ে ছিল। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে জানালেন, সাগ্রহী তিনি।

‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এর পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও মূল অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। ছবি: সংগৃহীত

তারপর একদিন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা
ইতিমধ্যে কেটে গেল চার বছর। এই চার বছর ছবিটা ফারুকী আর নওয়াজ দুজনের ভেতরেই গল্পটা গেঁথে ছিল ‘ক্যানসারের’ মতো। দুজনের যাত্রা চলছিল তাঁদের নিজস্ব গতিতে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ফারুকী নতুন একটা ছবির কাজ শুরু করার জন্য গোপনে তৈরি হচ্ছেন। ১০ মার্চ থেকে শুরু হবে শুটিং। হঠাৎ একদিন দুপুরের ভাতঘুমে ফারুকী দেখলেন, সমুদ্রের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই স্বপ্ন অথবা ঘোরের ভেতর কিংবা মাথার ভেতর অবচেতনভাবেই তৈরি করা সেই দৃশ্যে এই নির্মাতার মনে হলো নওয়াজ বিষণ্ন। এরপর বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফারুকী তাঁর ‘ভাই-ব্রাদার’দের বললেন, ‘এই স্বপ্নের মানে কী বুঝলাম না। এটা কি আমার জন্য কোনো সিগন্যাল যেন আমি নতুন ছবি বাদ দিয়ে “নো ল্যান্ডস ম্যান”-এই ফিরে যাই?’

এর ১০ মিনিট পর ফারুকীর ফোনে এল একটা মেসেজ। প্রায় দুই বছর পর নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘তুমি কেমন আছ?’ এই অদ্ভুত যোগাযোগে গা শিউরে উঠল পরিচালকের।

এরপর হোয়াটসঅ্যাপে আলাপের সময় নওয়াজুদ্দিন বলে ফেললেন, ‘আমরা কি “নো ল্যান্ডস ম্যান” বানাতে পারি না?’ সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ। ফারুকী বললেন, ‘পারি। কিন্তু আমার তো ফান্ড নেই!’ নওয়াজ বললেন, ‘তুমি কি ২২ তারিখ আসতে পারো মুম্বাই?’

ফারুকী ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার করলেন তাঁর ভিসাই নেই।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ছবি: আবদুস সালাম

যা হোক, পরিচিতজনদের সহযোগিতায় তিনি ২১ তারিখ সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গেলেন মুম্বাই। সেখানে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর অফিসে বসে ঠিক হয়, ছবিটির প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হবেন তিনি। আর শিগগিরই শুরু হবে নিউইয়র্ক আর সিডনি অংশের শুটিং। তাই এই নির্মাতার মনে হয়, ‘সবকিছুর জন্য একটা পূর্বনির্ধারিত সময় আছে। সময়টা যখন আসবে, তখনই সেটা ঘটবে। এর এক দিন আগেও না, আধা দিন পরেও না!’

শুরু হলো শুটিং
এর মাত্র এক মাস আগে এই অভিনেতা হাতে (পড়ুন মেইলে) পেয়েছিলেন চূড়ান্ত চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্য পড়ে তিনি এই পরিচালককে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দুর্দান্ত।’ তখন তিনি ‘ব্যাক টু ব্যাক’ ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী নভেম্বরের শীতে যোগ দিলেন ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’–এর শুটিংয়ে। শুটিং শুরুর আগের রাতে নওয়াজুদ্দিন হাসছেন, খাচ্ছেন, গল্প করছেন। পরিচালকের একবার মনে হলো, এই চরিত্র করার জন্য নওয়াজুদ্দিন তৈরি তো? পরদিন যখন ক্যামেরা অন হলো, পরিচালকের ভাষায়, ‘মুহূর্তেই চেনা নওয়াজ চিত্রনাট্যের সেই চরিত্র হয়ে উঠলেন। কেবল পোশাক বা মেকআপে নয়, চোখ, চোখের তারা, অভিব্যক্তি—সব বদলে গেল। তখন আমি জানলাম, আমি সঠিক মানুষটাকে পেয়েছি।’

মূল অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে পরিচালক। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুটিংয়ের এক ফাঁকে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী ফারুকীকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি জানতে আমার বোনের নাম সাইমা?’ কারণ, চিত্রনাট্যেও নওয়াজুদ্দিনের বোনের নাম সাইমা। ফারুকী জানালেন, তিনি জানতেন না। পরে এই নির্মাতা জেনেছিলেন, নওয়াজুদ্দিনের বোন সাইমা দীর্ঘ আট বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। আর নিউইয়র্কের ঝকঝকে এক দিনে যখন শুটিং চলছে, তখন অনেক মাইল দূরে লড়াইয়ে ক্ষান্ত দিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেলেন নওয়াজুদ্দিনের সেই বোন সাইমা। ফোনে বোনের মৃত্যুর খবর শুনে ফোন রেখে সুন্দরভাবে শট শেষ করেছিলেন নওয়াজুদ্দিন। একেই বোধ হয় বলে জাত অভিনেতা!

ফারুকীর চোখে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী
এই অংশটা শোনা যাক এ নির্মাতার মুখে, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সাবলীল, সবচেয়ে জাদুকরি অভিনেতার নাম নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। তাঁর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় দিক হলো, তাঁর অভিনয় দেখে চেষ্টাটা মোটেই টের পাওয়া যায় না। মনে হয়, অভিনয়টা খুব সহজ, স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। লিওনেল মেসি যখন পাঁচজনকে ড্রিবল করে পেনাল্টি বক্সের দিকে ছুটে যায়, দেখে মনে হয়, এত সহজ। কোনো চেষ্টাই নেই। এটা তো যেকেউ পারে। কিন্তু আমি যদি কাজটা করতে যাই, প্রথম দর্শকদের যেটা চোখে পড়বে, সেটা আমার চেষ্টা। যেন আমি জীবন দিয়ে চেষ্টা করছি। এই চেষ্টাটা চোখে পড়ে কখন? যখন সে কাজটা ভালো জানে না, পারে না। তাই চেষ্টাটা বের হয়ে আসে, চোখে পড়ে। আমাদের মায়েরা যেমন গল্প করতে করতে, হয়তো একটু খুন্তিটা নাড়ল, আর অনায়াসে রান্না হয়ে গেল। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীও সেই রকম অভিনেতা।’

শুটিংয়ের দিনগুলোয় নির্মাতার চ্যালেঞ্জ
এই নির্মাতার প্রথম যুদ্ধ ছিল নিউইয়র্কের তীব্র শীতের সঙ্গে। নভেম্বর রেইনে আকাশ থেকে ঝরল কুচি কুচি বরফ। তাপমাত্রা শূন্য বা এক ডিগ্রি। আর তা অনুভূত হতো মাইনাস পাঁচ ডিগ্রির মতো। সেই শীতের ভেতরে সকাল ছয়টার ভেতর গোসল করে, ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে লোকেশনে যেতে হতো। ঠান্ডার চেয়েও বড় শত্রু আছে। তার নাম ঠান্ডা বাতাস। সে সময় হাত ও পায়ের মোজার ভেতর ওয়ার্মার দিয়ে দুই ঘণ্টা মতো হাত–পা গরম রাখতেন তাঁরা। তবে এই নির্মাতা এ-ও বলেন, ‘যখন প্রতিকূল আবহাওয়া হয়, তখন বোধ হয় মানুষ সংঘবদ্ধ হয়। বিপদে দুটি মানুষ কাছাকাছি চলে আসে। এই ব্যাপারটা আমাদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে। প্রতিকূল আবহাওয়া আমাদের কাছাকাছি এনেছে। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়া, স্ক্রিপ্টের চাহিদা, সবার বাড়তি প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে কাজটা বের করে আনতে পেরেছি।’ আরও একটা ‘মজার সংকটের’ কথা বললেন এই নির্মাতা। নিউইয়র্কে শুটিংয়ের দিনগুলোয় রাতের বেলা নাকি তাঁর মাথায় ঘুরত বাংলাদেশের ঘড়ি। আর দিনের বেলা ঘুরত নিউইয়র্কের ঘড়ি। ফলে ২৪ ঘণ্টাকেই তাঁর মনে হতো দিন। মনে হতো ‘উল্টো ঝুলে আছেন’। তাই নাকি ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না তিনি।

শুটিংয়ের দিনে শিল্পী ও কলাকুশলীরা। ছবি: সংগৃহীত

‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ এখন কোথায়?
এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা মহাদেশের গল্প আছে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এ। ইতিমধ্যে আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া অংশের শুটিং শেষ। কিছুদিন পর শুরু হবে ভারতের অংশের শুটিং। আগামী দেড় মাসের ভেতর শেষ হবে এই ছবির শুটিং। মূল তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, তাহসান খান ও মিশেল মেগান। চরিত্রদের সম্পর্কে জানতে চাইলে এই নির্মাতা কেবল বললেন, মেগান অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক, সে কিছুদিনের জন্য নিউইয়র্ক এসেছে। তাহসান খান একজন বাংলাদেশি, যিনি নিউইয়র্কে থাকেন। আর নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী ভারতীয়, যিনি নিউইয়র্ক এসেছেন। ব্যস, এটুকুই। তবে এটুকু বললেন, বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় এই গল্প অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এবেলা বলে রাখি, ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর প্রথম ইংরেজি ছবি, যেখানে তিনি মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর এই অভিনেতার ফেসবুক পেজে গেলে দেখবেন, সেখানে কভার ফটোতে শোভা পাচ্ছে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’।