Thank you for trying Sticky AMP!!

অঞ্জু ঘোষকে বানিয়েছিলাম ট্রিপল কুইন!

‘নরম-গরম’ ছবির দৃশ্যে অঞ্জু ঘোষ

‘বাতাসে গুঞ্জন’ বলে আগে একটা কথা ছিল। এখন সেই গুঞ্জন শোনা যায় না। বাতাসের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সবকিছু ছড়িয়ে যায়। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে বাতাসে গুঞ্জন ছিল। গুঞ্জন উঠল, ঢাকাই মুভিতে এক ঝাকানাকা নায়িকা এসেছেন!

মুভির নায়িকারা গাছের মতো। চারাগাছ থেকে আস্তে আস্তে বাড়ে। কিন্তু এই নায়িকার বাড়াবাড়িটা অন্য রকম। সরাসরি বৃক্ষ হয়েই আবির্ভাব। চিটাগাং থেকে ঢাকা। নেমেই ভূমিকম্প! নাম অঞ্জু ঘোষ।

বন্ধু বাদল মুভির পোকা। ভিসিআরের হিন্দি থেকে বড় পর্দার বাংলা। হালিম মামুর চার চাক্কার স্পেশাল নল্লি চিবাতে চিবাতে বলে, ‘অঞ্জুর ঘটনা শুনছোস তো?’ বললাম, ‘শুনসি, সিগারেট খাইসে বইলা হামিদ ভাই মঞ্জুরে চড়াইসে।’ বলে, ‘আরে মঞ্জু না, অঞ্জু। সওদাগরের অঞ্জু ঘোষ। হেব্বি জোস!’ বলে থাম্বস আপ দেখায়।

বাদলের ওপর আমার আস্থা আছে। ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখে দেখে কমার্শিয়াল মুভির নান্দনিকতায় তার পিএচডি হয়ে গেছে। তার মানে, অঞ্জু ঘোষ কিছু একটা। কিছু বললাম না। আমাকে সবাই ইংলিশ মুভির পোকা জানে। ইংলিশ ভাব বজায় রাখলাম চুপ থেকে।

কিন্তু এক ‘বেদের মেয়ে’ ৯ রিখটার স্কেল ভূমিকম্পে যখন দেশ কাঁপিয়ে দিল, আমার মতো এক ‘মেরিলিন মনরো-সোফিয়া লোরেন-লিন্ডসে ওয়াগনার’–পাগলের কপালে ভাঁজ পড়ল। কাউকে না জানিয়ে দেখতে গেলাম ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’কে। একা। বলাকা হলে। ব্ল্যাকে এত বেশি দামে এই প্রথম টিকিট কিনলাম। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছি বেদের মেয়েকে।

‘নরম-গরম’ ছবির দৃশ্যে ওয়াসিম ও অঞ্জু ঘোষ

বাংলাদেশের সাধারণ মুভি–দর্শকদের পছন্দ একটু ভারী নায়িকা। অঞ্জুর তা ১০০ ভাগ আছে। ইংলিশে একে বলে ‘Chubby’ বা ‘Curvy’! আরেকটু ক্লিয়ার করলে বলতে হবে, ভরাট শরীর কিন্তু শিল্পীর তুলিতে ঢেউয়ের আঁচড়ে আঁকা। অঞ্জুর চোখ সুন্দর। চাহনিতে মাদকতা। টাংকি মারা চাহনি। পুরুষ হলে গলবেই। রোবট হলে আলাদা কথা। আমি গললাম। তাঁর উচ্ছল হাসি শুনতে ইনোসেন্ট, দেখতে আবেদনময়ী। ঠোঁট সামান্য বাঁকা করে হাসে। আর নাচ? ভয়াবহ! তাল-লয়-মুদ্রা জানে সে। আরও জানে, দর্শক কী চান! তাহলে কি শুধু হাসি, টাংকি আর নাচে মজে গেছি? হলিউড-বলিউড ঘাঁটা ছেলে আমি। এই ছোট্ট ছেলে আমাকে মাতিয়েছে সোফিয়া লোরেন, কাঁপিয়েছে অড্রে হেপবার্ন। ‘বায়োনিক ওম্যান’ লিন্ডসে ওয়াগনারের সব কটি কস্টিউম আমার মুখস্থ। আমি জানি, মুম্বাইয়ের রেখা নাচলে মনে হয় তাঁর শরীরে হাড্ডি নেই। শ্রীদেবীর চাহনি আর ফোলা ফোলা ঠোঁটের এক্সরে রিপোর্ট দিতে পারব। জয়াপ্রদার স্বর্গীয় হাসিতে দন্তকপাটির কয়টা সুডৌল ঠোঁটে ঢাকা থাকে, সে হিসাব জানা আছে আমার। আমাকে কাঁপানো এত সোজা?

আসলে কাঁপিয়েছেন অন্য জায়গায়। অঞ্জু ঘোষ অভিনয় করেন চমৎকার। বেশির ভাগ দর্শক গেছেন অঞ্জুকে দেখতে, তাঁর নাচ দেখতে, কটাক্ষ চাহনির আবেদন দেখতে। কিন্তু তাঁরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তাঁরা অঞ্জুর অভিনয়ের পাল্লায় পড়েছেন। যখন কাঁদেন, কাঁদার মতোই কাঁদেন। যখন হাসেন, হাসার মতোই হাসেন। যখন নাচেন, নাচার মতোই নাচেন। হ্যাঁ, তাঁর আবেদনময়ী নাচ একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু নাচ–গান এই উপমহাদেশের কোন বাণিজ্যিক ছবিতে নেই? ফ্যান যে হয়েছি, বাদলকে বলা যাবে না। অঞ্জু ঘোষের মুভি মিস করা যাবে না একটাও। শুরু হলো অঞ্জু অভিযান!

অঞ্জু ঘোষ

অভিযান শুরু করলেন প্রযোজক-পরিচালকেরাও। বুঝলেন, অঞ্জু হচ্ছেন কমার্শিয়াল ছবির মেসি-নেইমার। মাঠে থাকলেই দর্শক আসবেন। হট কেক। কেক যখন হট, ছবির নামে গরম থাকলে সমস্যা কী? ছবি হলো ‘নরম-গরম’! এ অবস্থায় আপনি বিপদে পড়বেন। ছবির নাম ‘নরম-গরম’, আর সেখানে খোদ অঞ্জু! প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। এই পূর্ণ আর অপূর্ণ হয় না। মজার বিষয়, ছবির কাহিনি খুব সোজা। নারীদের মন নরম, কিন্তু নির্যাতিত হলে যে তাঁরা কত গরম হতে পারেন, তা-ই দেখানো হয়েছে নরম-গরমে। পরিচালক সম্ভবত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বাণী থেকে থিমটি নিয়েছিলেন, ‘নারীরা হচ্ছেন টি–ব্যাগের মতো। গরম পানিতে ছাড়লেই বোঝা যায়, কার কত ঝাঁজ!’

সুপার–ডুপার হিট ‘নরম-গরম’-এ দর্শক টের পেলেন অঞ্জুর কত ঝাঁজ! নির্মাতারা এগিয়ে গেলেন আরেক ধাপ। এবার ছবির নাম ‘গরম মসলা’! ঠ্যালা সামলান। অঞ্জু প্লাস গরম মসলা। সোজাসাপটা ‘কাচ্চির সঙ্গে বোরহানি’! সুপারহিট। ছবির কাহিনি কিন্তু সিম্পল। অঞ্জুর চরিত্র খুব নরম। তাকে যত নির্যাতন করাই হোক, সহজে সে রাগে না। কিন্তু তার এক অদ্ভুত নেচার আছে। গরম মসলা নাকে শুঁকিয়ে দিলেই রাগ উঠতে থাকে। গরম মসলার ঝাঁজে আস্তে আস্তে ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে অঞ্জু। বিষয়টা মজার।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির দৃশ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ

বেশির ভাগ মুভিতে অঞ্জু ঘোষের পর্দায় উপস্থিতিটা ছিল ইন্টারেস্টিং। সাধারণত প্রথম আধা ঘণ্টা নির্মাতা অঞ্জুকে পর্দায় আনতেন না। ছোট্ট এক মেয়েশিশু থেকে বড় হতো অঞ্জু। নাচপাগল দর্শক অস্থির থাকতেন, বড় হচ্ছে না কেন বাবুটা? কতক্ষণ আর ছোট্ট থাকবে? বড় হয়ে অঞ্জু হবে না? হ্যাঁ, বড় হতো অঞ্জু। হঠাৎ করে বড় হতো। বিগ ক্লোজ শটে উপুড় করা রঙিন কলসিতে দেখা যেত এক জোড়া পায়েল পরা পায়ের পাতা তবলা বাজাচ্ছে। হল ফেটে পড়ত চিৎকারে! যেন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা গোল করেছে, অথবা তামিম ইকবাল এক হাতেই মেরেছেন ছক্কা! ঝাঁকুনি দিয়েই পর্দায় ‘হ্যালো’ বলতেন অঞ্জু।

এলাকায় রটে গেছে, আমি নিয়মিত অঞ্জুর মুভি দেখি, তাঁর বিগ ফ্যান। একদিন এলাকার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ছেলে এল। ইতস্তত করে বলে, ‘ভাইয়া, আমরাও অঞ্জু ঘোষের ফ্যান। আপনের কথা শুইনা সাহস কইরা আসলাম। অঞ্জু ফ্যান ক্লাব বানামু। সবতে মিল্যা অঞ্জুর ছবি দেখমু আর সবাইরে গল্প কইয়া কইয়া দেখতে লইয়া যামু। আপনে থাকবেন প্রেসিডেন্ট।’ বললাম, ‘নো প্রবলেম। আমার রুমই হতে পারে সেই ক্লাবের অফিস। এই যে দেখো।’ বিছানার পাশের দেয়াল দেখে ওরা চমকে ওঠে। আমার রুমটা ওদের চেনা। একজন চিৎকার করে বলে, ‘আয় হায়, ডিন জোনস গ্যাসে কই?’ বললাম, ‘ওই যে।’ ওরা দরজায় তাকায় ।

অঞ্জু ঘোষ

ঘটনাটা এ রকম। অস্ট্রেলিয়ার স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান (বর্তমান ধারাভাষ্যকার) ডিন জোনস ছিল আমার প্রিয় খেলোয়াড়। ওর একটা পোস্টার ছিল আমার বেডের পাশের দেয়ালে। ওখানে এখন শোভা পাচ্ছে অঞ্জু ঘোষের মাঝারি সাইজের একটা ছবি। ওপরের কোনায় আঠা মেরে লাগিয়েছি তাশের তিনটা কুইন—স্পেইড, হার্ট, ডায়মন্ড। ট্রিপল কুইন। দরজায় ঝুলে এখন ট্রিপল কুইনের দিকে ব্যাট হাতে তাকিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ার ডিন জোনস!

এবার একটা গোপন কথা বলি। ‘নরম-গরম’ ছবিটা আমি ১১ বার দেখেছিলাম। ১১তম বার যখন সিনেমা হলে ঢুকছি, গেটম্যান আমাকে বলল, ‘ভাইজান, আইজকা যাওয়ার সময় দেখা কইরা যাবেন।’ কিছু না বুঝে ঢুকে গেলাম হলে। শো শেষে বের হওয়ার সময় গেটম্যান আমাকে দূরে নিয়ে যায়। হেসে বলল, ‘আপনাকে অনেক দিন দেখতেসি। আপনার জন্য এই গিফটটা রাইখা দিসি। নেন।’ দেখি ‘নরম-গরম’ ছবির একটা পোস্টার রোল করা। ‘থ্যাংক্যু’ বলে নাম জিজ্ঞেস করলাম। ‘লোকমান।’ কখনো কখনো অলৌকিকভাবে কিছু কিছু জিনিস ম্যাচ করে যায়। তখনকার সময় ফুটপাতে এক টাকায় ভিউ কার্ড বিক্রি হতো। প্রিয় হলিউড লিজেন্ড মেরিলিন মনরোর একটা কার্ড কেটে তার হাসিমাখা ফেসটা আমি ওয়ালেটের ছবি রাখার জায়গায় রেখেছিলাম। লোকমানকে বললাম, ‘তুমি আমেরিকার নায়িকা মেরিলিন মনরোকে চেনো?’ লোকমান বলল, ‘আমরা গরিব মানুষ, চিনব কীভাবে?’ বললাম, ‘এই যে দেখো।’ লোকমান বলে, ‘ভাইজান, এইটা আসল নাকি আঁকা?’ বললাম, ‘আসল।’ অবাক হয়ে সে বলে, ‘মানুষ এত সুন্দর হয়?’ বললাম, ‘মানুষ সবাই সুন্দর। আমি তোমাকে এটা গিফট করলাম, নাও।’

ভয়াবহ খুশি হয়ে বুকপকেটে মেরিলিন মনরোকে রাখল লোকমান। হলের ফুড কাউন্টারে ওকে হট প্যাটিস (গরম কিন্তু নরম না) আর ফান্টা খাওয়ালাম। হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলাম। দুজন দুদিকে চলে যাচ্ছি। লোকমানের বুকে মেরিলিন মনরো, আমার হাতে অঞ্জু ঘোষ!