Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রকৃত নক্ষত্রের মৃত্যু নেই

‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা।

নক্ষত্র ঢলে পড়ল, কিন্তু প্রকৃত নক্ষত্রের কি মৃত্যু হয়? কী এক শুভক্ষণে এক নক্ষত্রের মাধ্যমে আরেক নক্ষত্রের সঙ্গে আমার মিলন। মানিকদা, মানে সত্যজিৎ রায়ের সুবাদে সৌমিত্রদার সঙ্গে।
বছরটা মুক্তিযুদ্ধের পরপর, ১৯৭২ সাল। তাই স্পষ্ট মনে আছে। বাংলা চলচ্চিত্রের অসামান্য শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। মানিকদার অশনি সংকেত চলচ্চিত্রের শুটিং সেখানেই শুরু হয়েছিল। শুটিংয়ের লোকেশনে সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।
প্রথম দেখায় সৌমিত্রদা তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার বয়স তখন খুবই কম। সিনেমার পর্দায় যাঁকে দেখে অভিভূত হচ্ছি, সেই তিনি এমন করে তাকাচ্ছেন। বেশ ভয়ই লেগেছিল। এত বড় মাপের অভিনেতা, মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই অহংকারী হবেন। কিন্তু এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন, যেন খুবই আপন কেউ। ভয় মুহূর্তে উবে গেল।
আমরা যখন শট দিতাম, সৌমিত্রদা মানিকদার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। পরে শুনেছি, এ ছবিতে অভিনয়ের সময় তিনি নাকি ডায়েরি রাখতেন। নানা খুঁটিনাটি লিখে রাখতেন।

‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা।

অশনি সংকেত ছবির শুটিংয়ে আমাদের দুই দফায় শান্তিনিকেতনে (বীরভূম) যেতে হয়। প্রথমবার গিয়ে থেকেছিলাম মাসখানেক। আমার শুটিং অভিজ্ঞতায় এর আগে যা কখনো দেখিনি, সে অভিজ্ঞতাই হলো। আমাদের এখানে একজন শিল্পীর অভিনয় দৃশ্যে অন্য কোনো সহ-অভিনেতার শুটিং না থাকলে ইউনিটের অন্য কাউকে দিয়ে সংলাপ দিয়ে দেওয়া হয়। সৌমিত্রদাকে দেখেছি, ক্যামেরার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সহশিল্পীর জন্য সংলাপ দিয়ে যাচ্ছেন। তাতে সংলাপটা কী যে স্বাভাবিক ও সুন্দর হয়ে উঠত। অন্যের অভিনয়ের জন্য, কেবলই শিল্পের জন্য এই দরদ কজনের হয়!
ক্যামেরার বাইরেও শুটিংয়ের সময় সৌমিত্রদাকে নানা কাজে জড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এমনও দেখেছি, তিনি নির্দ্বিধায় ট্রলি ঠেলছেন। অথচ তখনই তিনি কত বড় অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে শিল্পের প্রতি এই ভালোবাসাটা শিখেছি।
শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আমরা ট্রেনে যাওয়া-আসা করতাম। সৌমিত্রদা, মানিকদা, অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়, আমি—সবাই দল বেঁধে যাতায়াত করতাম। ট্রেন ভ্রমণের সময় হঠাৎ হঠাৎ শুনি, সবাই ‘দুগ্‌গা, দুগ্‌গা’ হেঁকে উঠছেন। দুর্গা দাশগুপ্ত ছিলেন মানিকদার সিনেমার সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। আমার বয়স কম। অতশত কি বুঝি?ববিত

ববিতা

সৌমিত্রদাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানিকদার ছবিতে বুঝি সাউন্ড রেকর্ডিস্টের গুরুত্ব অনেক বেশি। দাদা বললেন, ‘তা হবে কেন? সবাই গুরুত্বপূর্ণ।’ একটু পরে হেসে বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করেছ।’ আমার এ কথা শোনার পর সবার সে কী হাসাহাসি। আমি তো লজ্জায় অধোবদন।
অশনি সংকেত ছবির শুটিংয়ের সময় ঈদ চলে এসেছিল। ঈদের দিন শান্তিনিকেতনে শুটিং চলছে। আমার ভীষণ মন খারাপ। আমার মন ভালো করার জন্য সৌমিত্রদার উদ্যোগে সেমাই রান্না করা হলো। একেবারে বাচ্চা একটা মেয়ের মতো স্নেহ দিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
১৯৭৩ সাল আমার অভিনয়জীবনের সেরা বছর। সে বছর অশনি সংকেত মুক্তি পেল। এই সুবাদে কলকাতায় সৌমিত্রদার সঙ্গে আবার দেখা। কী একটা ছবির যেন শুটিং করছিলেন। তাঁকে দেখেই ‘দাদা’ বলে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিনিও স্নেহে আগলে নিলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশে নাকি তুমি অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছ। অনেক ছবিতে কাজ করছ। পুরস্কারও পাচ্ছ।’ অমন অভিনয়শিল্পীর মুখে এমন কথা শুনে লজ্জায় যেন মরে গেলাম।

‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা।

অশনি সংকেত নিয়ে আমরা একসঙ্গে দেশের বাইরেও গিয়েছি। ছবিটি তখনো থিয়েটারে মুক্তি পায়নি। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি আমন্ত্রণ পেল। আমিও তখনো ছবিটি দেখিনি। সৌমিত্রদা, মানিকদা, মানিকদার স্ত্রী সবাই ছিলেন। কী যে আনন্দ, কী যে উত্তেজনার সেসব দিন।
আমরা দিল্লি থেকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট গেলাম। সেখান থেকে যাব পশ্চিম বার্লিন। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে সবার ইমিগ্রেশন শেষ। আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট। আমাকে আটকে দেওয়া হয়। তখনো সম্ভবত জার্মানি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। কেঁদেকেটে একাকার। মানিকদা উৎসব কমিটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করছেন। আর সৌমিত্রদা আমাকে অবিরাম সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। একপর্যায়ে অনুমতি পাওয়া গেল।
‘কেমন আছ’, ‘শরীর কেমন’, এ ধরনের প্রশ্ন সৌমিত্রদা মোটেও করতেন না। যখনই বাংলাদেশে কোনো কাজে আসতেন, দেখা হতো, কথা হতো। অসাধারণ সময় কাটত। সাত বছর আগে আমাদের শেষবারের মতো দেখা হয়।
সৌমিত্রদা তো মানিকদার প্রিয়তম অভিনয়শিল্পী ছিলেন। সৌমিত্রদা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অভিভাবক। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের এক সৃষ্টিশীল অধ্যায় শেষ হলো। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, সৌমিত্রদা নেই। আমার হৃদয়ে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি, তাঁর মৃত্যু হবে না।