Thank you for trying Sticky AMP!!

একা কখনো ভালো থাকা যায় না

শিবলী মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

কেমন আছি? ফোন করে অভ্যাসবশত অনেকেই জানতে চান। আমি সচেতনভাবে বলি, আমি ভালো নেই। জীবনযাপনে একধরনের অস্থিরতা জন্ম নিয়েছে। বিশ্বের মানুষের অসহায়ত্ব দেখে আমিও অসহায় বোধ করছি। যদিও নিরাপদে আছি, কিন্তু আমি ভালো নেই। একা কখনো ভালো থাকা যায় না।

গত ২৮ দিন বাসা থেকে বের হইনি। যাতে আমার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটাই ছিল কারণ। আমি নিজেকে নিয়ে ভীত নই, ভীত আমার ৯২ বছর বয়সী মাকে নিয়ে। আমার কারণে যদি আমার মা বা ভাইবোন বা পরিবারের অন্য কেউ আক্রান্ত হন, সেটা নিয়ে আমার চিন্তা ছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখেছি। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে আমাদের পালাতে হয়েছিল। আমার এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। আমি যে বেঁচে আছি, এটা আমার বোনাস জীবন। জীবনে তেমন আর কোনো চাওয়ারও নেই। শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, সম্মান, ভালোবাসা কোনোটাই আমি কম পাইনি। সে জন্য পৃথিবীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু করোনা উপদ্রুত এই সময়ে এসে ভীষণ অসহায় বোধ করছি।

 আমাদের অনেকের হাতে হয়তো যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে। বাড়িতে আটকে থাকাটা তাদের জন্য তেমন কষ্টের ব্যাপার নয়। বাড়িতে বড় রান্নাঘর, রোজ দারুণ সব খাবার রান্না হচ্ছে। ঘরের ভেতর ব্যায়ামাগার করে ফেলেছে অনেকে। খাচ্ছে আর ব্যায়াম করছে। সেসব হয়তো তাদের ক্ষণিকের আনন্দ দেবে। কিন্তু তাদের জন্য যারা কাজ করে, সেই মানুষগুলোর কথা কি তারা কখনো ভেবেছেন? দৈনিক আয়ের ওপর যাদের সংসার টিকে ছিল, তারা ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

ধরা যাক আমাদের নৃত্য অঙ্গনের কথা। যে ছেলেমেয়েগুলো আমাদের দলে নাচ করে, তাদের সবাই অবস্থাপন্ন পরিবারের নয়। তাঁদের অনেকেই এখন ঘরে বসে আছে। তাদের অনেকের ঘরেই এখন খাবার নেই। যারা আমাদের মেকআপ করাতেন, আমাদের জন্য নাচের পোশাক তৈরি করতেন, আমাদের কাছে গয়না বিক্রি করতেন, মঞ্চে সেট তৈরি করতেন, আলোকসজ্জা করতেন, তাঁরা এখন কর্মহীন। মোটকথা নাচের মঞ্চের পেছনে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের এখন ভিক্ষা করারও উপায় নেই। সবাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। বাড়িভাড়া দেওয়ার টাকাও তাঁদের অনেকের হাতে নেই।

শিবলী মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

এরই মধ্যে প্রথম আলোয় শামীম আরা নীপার একটি লেখা পড়ে একজন দরদি মানুষ আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই অর্থ আমরা বেশ কজন স্বল্প আয়ের নাচের মানুষের কাছে পাঠাতে পেরেছি। আমি ও নীপা নিজেদের সাধ্যমতো আরও অনেককেই অর্থসহায়তা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা আমরা কদিনই বা পারব? রাজার ভান্ডারও এক সময় ফুরিয়ে যায়।

 আমাদের অনুষ্ঠান বন্ধ। নাচের স্কুলও বন্ধ। তবু আমরা নিজেরা হয়তো ছয় মাস বা এক বছর ভালোভাবে টিকে থাকতে পারব। কিন্তু আমাদের সঙ্গের স্বল্প আয়ের নাচের মানুষদের আমরা কীভাবে সাহায্য করব? আমরা যতটা পেরেছি, আন্তরিকতা থেকে চেষ্টা করেছি। আমরা জানি, অনেকেই সাহায্যের জন্য কারও কাছে হাত পাততে পারবেন না। তাঁদের ব্যাপারে সরকার ও বিত্তবানদের সহৃদয় সহযোগিতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিটি পেশার, প্রতিটি অঙ্গনের স্বল্প আয়ের ও দৈনিক আয়ের মানুষদের কথা সেই অঙ্গনের সামর্থ্যবান মানুষ, সমাজের বিত্তবান শ্রেণি ও সরকারকে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, একা একা ভালো থাকাকে ভালো থাকা বলে না।