Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ: আমাদের অর্জন

লায়লা হাসান। ছবি প্রথম আলো

জুলাই মাস আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি মাস। কেন প্রিয়? কারণ এ মাসেই আমার অত্যন্ত আপনজনদের অনেকেরই শুভাগমন ঘটেছে এই পৃথিবীতে। কিন্তু এ ছাড়া বিশেষ একটি কারণে এ মাসটি আমার ইচ্ছে পূরণের, আমাদের স্বপ্ন পূরণের আর দীর্ঘদিনের লড়াই বাস্তবায়নের মাস। ২০১৪ সালের জুলাই মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ২০০৯ সালে আমাদের গৃহীত উদ্যোগ আর আন্দোলন ২০১৪ সালে এসে বিজয়ের চূড়া স্পর্শ করেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার (বানৃশিস) দীর্ঘ ছয় বছরের লড়াইয়ের ফলাফল। ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি। এরপর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নৃত্যশিল্পী মীনু হক। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা নৃত্যশিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলাম, জাতীয় পাঠ্যক্রমে নৃত্য বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নানা কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান স্কুল-কলেজগুলোতে ‘নৃত্যকে জানো’ শীর্ষক বক্তৃতা-সেমিনার ও নৃত্য পরিবেশনা থেকে শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, শিক্ষা ও সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে দাবিদাওয়া উত্থাপন এবং জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন তৈরির সময় বেশ কয়েক দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। আমাদের প্রধান দাবি ছিল সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশ। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে নৃত্যকলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আশানুরূপ সাড়া পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা যৌথভাবে একটি সেমিনার আয়োজন করে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সহ-উপাচার্য হারুন অর রশিদ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ অন্য শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলাম নৃত্যকলা বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হোক। এ বিষয়ে তৎকালীন গণমাধ্যমে বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশ করেছি আমরা।

এ তো গেল আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞের কথা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কত যাওয়া-আসা, তৎকালীন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে কত বৈঠক, বিভিন্ন সভায় যোগদানের অনুরোধপত্র বিভাগীয় প্রধানদের কার্যালয়ে দিয়ে আসা, তাঁদের অসাক্ষাতে দরজার তলা দিয়ে চিঠি পৌঁছে দেওয়া আবার মোবাইলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া...কাজের কী আর শেষ আছে! আর এই গোটা উদ্যোগে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার বিশাল শিল্পী-কর্মী বাহিনী দিন–রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। সাজু আহমেদ, মীনু হক, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, আমানুল হক, তামান্না রহমান, শেখ মেহেদী, দীপা খন্দকার, মাহফুজুর রহমান, আনিসুল ইসলাম হিরু প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। বিশাল কর্মঠ এই দলের অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়ে গেল, কিন্তু তাঁদের সবার ঐকান্তিক পরিশ্রমেই আমাদের আন্দোলনটি ছয় বছর পর সফলতার মুখ দেখেছে।

একই দাবি নিয়ে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও সভা করেছিলাম। নানা সভা-বৈঠক আর উপর্যুপরি আলোচনার পর একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে এবং কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে জন্ম নেয় নৃত্যকলা বিভাগ। কলা অনুষদের অধীনে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই বিভাগ।

সব আরম্ভেরই একটি আরম্ভ আছে। আমাদের এই নৃত্য বিভাগের গোড়া পত্তনের মূলে যাঁকে আমরা সার্বক্ষণিক সাথি, উপদেষ্টা অভিভাবক ও পরামর্শদাতা হিসেবে পেয়েছি, তিনি হলেন তৎকালীন নাট্যকলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ইস্রাফিল শাহীন। তাঁর আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই অর্জন সম্ভব ছিল না। এরপর এলেন রহমত আলী। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম নাট্যকলা বিভাগের মাধ্যমে আমরা এগোব। কিন্তু কাজটি সহজ হলো না বলেই আমরা সংগীত বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হলাম। কত দিন মৃদুলের সঙ্গে বৈঠক করেছি, নানা পরামর্শ নিয়েছি কী করতে হবে, কোন পথে এগোব ইত্যাদি। ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট মৃদুলের জীবনাবসান হয়। বিভাগের পরবর্তী প্রধান হলেন কুহেলী ইসলাম। তাঁর সঙ্গেও অনেক আলোচনা হলো। শাহীনের পরামর্শমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও বিশ্বজিৎ ঘোষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের হারুন অর রশিদ, অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের আনোয়ার হোসেন প্রমুখ শিক্ষকেরা সে সময়ে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আর তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের কথা তো আগেও উল্লেখ করেছি। তিনি অম্লানবদনে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হওয়ার কারণে এবং রাজপথের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রেও তাঁরা সবাই আমার ঘনিষ্ঠজন। দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে কাজগুলো করতে হয়েছিল তখন। নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি হিসেবেও কাজগুলো আমার ওপরই বর্তায়।

লায়লা হাসান। ছবি প্রথম আলো

আমাদের এই লড়াইয়ের শেষ রক্ষাকারী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমেদ। এক বৃষ্টিস্নাত সকালে আমরা সদলবলে তাঁর দ্বারস্থ হয়ে দীর্ঘক্ষণ সভা করলাম। আমাদের কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে তাঁকে জানালাম। তিনিও বিষয়গুলো আগে থেকেই জানতেন। অবশেষে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।
বিভাগ তো হলো, এবার অর্থ! অর্থ বরাদ্দ না হলে তো কার্যক্রম শুরু হবে না! তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী। প্রথমে তিনি বাজেট স্বল্পতার কারণে বরাদ্দ দিতে না চাইলে আমরা বেশ জোর গলায় দাবি তুললাম। অবশেষে তিনি মঞ্জুরি কমিশন থেকে আমাদের অর্থ বরাদ্দের বন্দোবস্ত করলেন।
প্রতিটি অর্জনে সহযোগিতার কথা যেমন স্মরণ রাখতে হয়, তেমনি অসহযোগিতার ঘটনাগুলোও মনে রাখা দরকার। নৃত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি বারবার অধ্যাপক জামিল আহমেদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেও তিনি অনুমতি করেননি। একসময় তাঁর অসাধারণ মেধা আর সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি আমার নৃত্যানুষ্ঠানের সেট নির্মাণ করেছেন। আরেকজনের ব্যবহারে আমরা খুব মর্মাহত হয়েছিলাম, তিনি কলা অনুষদের তৎকালীন ডিন সদরুল আমীন। অবশেষে বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলো এবং এর বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন স্বনামধন্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

নৃত্যকলা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ একটি শিল্পমাধ্যম। নৃত্য জীবনের কথা বলে, আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নারীমুক্তি আন্দোলন, মানবাধিকার অত্যন্ত সরবভাবে নৃত্যকলায় উঠে এসেছে। ফতোয়াবাজবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে নৃত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই পাঠ্যসূচির মাধ্যমে সঠিকভাবে এর শিক্ষা প্রদানও অত্যন্ত জরুরি। এ তাগিদ থেকেই বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিভাগ চালুর বিষয়ে আমরা এখনো কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের বারবারই বলা হয় স্থান সংকুলান হবে না। প্রতিবারই আশ্বাস পাই সামনের বছরে হবে কিন্তু আজ পাঁচ-সাত বছর কেটে গেল, সামনের বছর আর আসে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা নৃত্য বিভাগ চালুর বিষয়ে আলোচনা করছি কিন্তু ভাগ্যের শিকে আর ছিঁড়ছে না! স্থানের অভাবের কথাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের বলেছিল, কিন্তু আমরা জায়গা করে নিয়েছি। প্রশাসনের ঐকান্তিক সহযোগিতা থাকলে আমরা নৃত্যশিল্পীরা সে ব্যবস্থা করতে পারব বলে আশা করি। আমাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। চলবে অবিরাম।