Thank you for trying Sticky AMP!!

শ্রদ্ধেয় আলী যাকেরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলী যাকের

ছোটলু ভাই। শ্রদ্ধেয় আলী যাকের। অনন্তকালের পথে যাত্রা করেছেন ২৭ নভেম্বর। তাঁকে বেশ কিছু কথা বলার ছিল; অথচ বলা হলো না। হবেও না আর। এই না-বলা কথাগুলো আমাকে জীবনের বাকি দিনগুলোতে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রাখবে।
সেই কবে, ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তাঁর হাত ধরে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে প্রবেশ; পরবর্তীকালে শব্দ এবং সংগীত পরিকল্পকের দায়িত্ব পাওয়া। সেই থেকে একটা দীর্ঘ সময় তাঁর সাহচর্যে নানা বিষয়ে বিভিন্নভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি। আসলে এত কিছু লেখার আছে, যার বেশির ভাগ নাটকের বাইরে, ভীষণ ব্যক্তিগত; অজস্র সব মুহূর্ত। এখানে কেবল কয়েকটি বিষয়ের কথা লিখব।
মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় ছোটলু ভাইয়ের বাসায় আড্ডা হতো; যেখানে শিল্প-সাহিত্যই প্রাধান্য পেত আলোচনায়। বেশির ভাগ সময় চলত কবিতা পাঠ। ছোটলু ভাইয়ের অনেক প্রিয় কবিতার মধ্যে দু-একটি কথা খুবই মনে পড়ছে। ভীষণ আবেগ দিয়ে পাঠ করতেন জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি। স্মৃতি থেকে কবিতার দুটি লাইনও মনে পড়ছে: ‘আকাশের চাঁদের আলোয়, এক ঘাই হরিণীর ডাক শুনি’।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর ‘কলকাতার যিশু’ কবিতাটিও খুব পছন্দ করতেন। ‘ভিখিরি মায়ের শিশু, কলকাতার যিশু, সমস্ত ট্রাফিক তুমি থামিয়ে দিয়েছো কোন মন্ত্রবলে’। মনে হতো বুকের ভেতরে বুঝি একটা আর্তনাদ হলো। পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতা ‘বড়ে গোলাম’ ওঁর পছন্দের ছিল। উৎপল দত্তের ‘চায়ের ধোঁয়া’ থেকেও একটি বা দুটি প্রবন্ধ পাঠ করতেন মনে পড়ে। কবিতা অথবা প্রবন্ধ সবই পাঠ করতেন প্রচণ্ড আবেগঘন কণ্ঠে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের (৬ নভেম্বর ১৯৪৪–২৭ নভেম্বর ২০২০)।

নাটকে শব্দ ও সংগীত পরিকল্পনার প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। ছোটলু ভাই নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকের শব্দ ও সংগীত পরিকল্পনার কথা মনে পড়ে। নাটক শুরু হওয়ার আগে উনি চেয়েছিলেন ১৫ মিনিট রবীন্দ্রসংগীত বাজবে এবং সে অনুযায়ী কিছু গান নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের দলের খালেদ খান, নিমা রহমানসহ অনেকে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এরপর শুরু হলো আমার পালা। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশ বেতারের সেতারবাদক এবং বেহালাবাদক প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টা করেও আমার পরিকল্পনার কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। চরম হতাশার মধ্যে ছোটলু ভাই পরামর্শ দিলেন পরিকল্পনা পরিবর্তন করার এবং ওই অংশগুলো সম্মিলিত কণ্ঠে ধারণ করার। যখন নাটক মঞ্চস্থ হলো, তখন দেখলাম ছোটলু ভাইয়ের সিদ্ধান্তটি নাটকের আবহকে নতুন এক মাত্রা প্রদান করেছে।

মনে পড়ে ছোটলু ভাই নির্দেশিত নাটক দর্পণে শরৎশশীর কথা যেটা প্রযোজনা করেছিল দেশ নাটক। ভীষণ কঠিন সমস্যায় পড়লাম; কারণ নাটকটি ১০০ বছর আগের। নানা নাটকীয় ঘটনার পর কাজটা সম্পন্ন করলাম এবং ছোটলু ভাই ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন।

‘গ্যালিলিও’ নাটকে আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: প্রথম আলো

নাটকের প্রসঙ্গে আরও মনে পড়ছে ওনার নির্দেশিত খাট্টা তামাশা নাটকের কথা। পটভূমি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়কার। ঠিক করলাম হারমোনিয়াম এবং তার সানাই ব্যবহার করব। সেই কবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একজনকে দেখেছিলাম হারমোনিয়াম উল্টো করে ধরে রিড না দেখে বাজাতে। দুই সপ্তাহের অক্লান্ত চেষ্টার পর তাঁকে খুঁজে বের করলাম; তিনি নকুল বিশ্বাস নামে পরিচিত। হারমোনিয়াম বাজান জাদুকরের মতো। কিন্তু বাদ সাধল তখন বোধ করি বাংলাদেশের একমাত্র সানাইবাদকের। নামটা মনে নেই, যিনি কিছুতেই নকুল বিশ্বাসের বাজানো সুরের সামান্যতম অনুসরণ করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁর বদলে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ বেতার থেকে দোতারাবাদক এনে কোনোমতো কাজটি শেষ করলাম, কিন্তু শতভাগ সন্তুষ্টি পেলাম না। কোপেনিকের ক্যাপ্টেন ছিল সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নির্দেশিত এবং প্রোডাকশন ডিজাইনে সমৃদ্ধ একটি নাটক, যা বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে নিয়ে গিয়েছিল এক উচ্চতর মাত্রায়। এই নাটকে কাজ করে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম।

এখানে উল্লেখ করতেই হয়, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ছোটলু ভাই। তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় ড. নওয়াজেশ আহমদের সঙ্গেও; নওয়াজেশ ভাই একাধারে উদ্ভিদ জিনতত্ত্ব বিশারদ, প্রথিতযশা আলোকচিত্রী; রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র নিয়ে ওনার তোলা ছবি দিয়ে সাজানো অসাধারণ একটি বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন: ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার অব বাংলাদেশ। এই বইতে ছোটলু ভাইয়ের তোলা অনেক ছবিও স্থান পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে ওনার সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ জন্য আবারও সশ্রদ্ধ চিত্তে ছোটলু ভাইয়ের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

মঞ্চে গ্যালিলিও–র চরিত্রে আলী যাকের (ডানে)

সেই কবে মনে করতে পারছি না শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষ এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ছোটলু ভাইয়ের বাসায়। কিছু প্রশ্ন ছিল কবির প্রতি। তবে শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষের কাছে আমার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন ছিল, ‘দেশ’ পত্রিকার শাস্ত্রীয় সংগীত সমালোচক শ্রী নীলাক্ষ গুপ্ত সম্পর্কে। কী সুপ্রসন্ন ভাগ্য আমার, অতি সহজেই আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই, যেটা আমার পক্ষে কলকাতায় ওনার সঙ্গে দেখা করে পাওয়া অসম্ভব ছিল। অনেক বছর পরে, ৯৬ কি ৯৭ হবে, মনে নেই, ভুলও হতে পারে। ছোটলু ভাই বললেন তোদের (আমার স্ত্রী এমি ও আমি) রতনপুর নিয়ে যাব।

মঞ্চে আলী যাকের

তিনি কথা রাখলেন। ঠিকই নিয়ে গেলেন আমাদের। রতনপুর পৌঁছে দেখি উনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। পাড়ে রাখা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠলাম আমরা। শিবপুরে আচার্য আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জন্মস্থানে যাচ্ছি আমরা, বললেন তিনি। মৃদু শিহরিত হলাম, আনন্দে মন ভরে গেল। সেসব দেখে ফিরে এলাম আবার রতনপুরে। পরদিন সকালে ওনার পৈতৃক বাড়িতে অনেক কিছু দেখালেন, বিশেষ করে পুকুরপাড়ে যেখানে ওনার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা ইংরেজি কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। দুপুরের পর রওনা দিলাম ঢাকার পথে, পাথেয় হয়ে থাকল অনাবিল সুন্দর সব মুহূর্ত। ১৯৭৩ থেকে এতটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি ওনার সঙ্গে, সাহচর্যে; অজস্র সব মণিকাঞ্চন জমা হয়েছে; স্মৃতির অতল থেকে সেসব তুলে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং অপার স্নেহ তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি, তা আমার এবং আমাদের জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(লেখক: চিত্র ও সংগীত বিশেষজ্ঞ ও সংগ্রাহক, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য।)