Thank you for trying Sticky AMP!!

সালমান ও আমার সম্পর্ক গভীর ছিল: মৌসুমী

১৯৯৩ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সোহানুর রহমান সোহানের এই ছবির মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষেরা পেয়েছিল দুটি নতুন মুখ—মৌসুমী ও সালমান শাহ। প্রথম ছবিতেই তাঁরা বাজিমাত করেন—অভিনয় দিয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেন। ২২ বছর আগে সালমান শাহ মারা যান। মৌসুমী ফ্যান ক্লাব গতকাল রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরায় ম্যারি মন্টানা রেস্তোরাঁয় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই ছবি নিয়ে অনেক অজানা গল্প। বলেছেন পরিবার, স্বামী আর চলচ্চিত্রের আরও অনেক বিষয় নিয়ে।

মৌসুমী

ভক্তরা আপনার ছবির ২৫ বছর পূর্তি নিয়ে চমৎকার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। অনুভূতি বলুন?
অনেকের হয়তো অনেক টাকাপয়সা থাকে, তারা এমন ভালোবাসার ভাগীদার হতে পারে না। দেশের নানা জায়গা থেকে যেমন এসেছে, তেমনি বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেস্ট হাতে পেয়েছি। এমন অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা হয় না। এসব অনুভূতিই একজন মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়।

স্বামী ওমর সানীর সঙ্গে মৌসুমী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে যুক্ত হয়েছিলেন কীভাবে?
আমার জীবনে বেশির ভাগ জিনিস এমন করেই হয়। যুক্ত হলে পরিকল্পনা তৈরি হয়ে যায়। আমি আগে থেকে সফলতা নিয়ে ভাবি না। কেন জানি বুঝে যাই, সফল আমি হবই। কারণ আমি যা করি, মনপ্রাণ দিয়ে করি। আমার ছবির প্রস্তাবগুলো আসত গুলজার (পরিচালক মুশফিকুর রহমান) ভাইয়ের মাধ্যমে, তখন তিনি ছিলেন সাংবাদিক। আমার সাক্ষাৎকারের পরিকল্পনা করেন। সোহান ভাই বন্ধু হয়ে ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরে হ‌ুমায়ুন রোডের বাসায় এসেছিলেন। সেখানেই চলচ্চিত্র আগ্রহী কি না, কৌশলে জানতে চান। তখন আমি স্থিরচিত্র আর বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়ে খুশি ছিলাম। মধ্যবিত্ত পরিবার, তাই নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করিনি। গুলজার ভাই বললেন, ধরুন, হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ যদি বাংলায় রিমেক হয়। আপনি জুহি চাওলার চরিত্রটা করবেন, আমির খানের চরিত্রে নোবেল, তৌকীর আহমেদ কিংবা জাহিদ হাসানও হতে পারেন। তাঁরা জানতেন, তৌকীর ভাই আর নোবেল ভাইয়ের ভক্ত আমি। তখন কিছুটা আগ্রহী হলাম, কারণ সহশিল্পী হিসেবে পছন্দের শিল্পীরা থাকবেন। আমি তখন থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। কীভাবে বাসায় বলা যায়, উপায় খুঁজছি। এরপর আরও অনেক ছবির প্রস্তাব পেয়ে আমি কনফিউজড হয়ে যাই। মনে মনে বাছাই করতে থাকি, কার ছবি করব? ঘুরেফিরে দেখি, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে প্রথম দিনের সংলাপ কী ছিল?
আমাকে ভয়ে কোনো সংলাপ দেওয়া হয়নি। সেদিন ক্যামেরার সামনে ভয়ে কাঁপছিলাম। একটি দৃশ্য ছিল, ওই দিন একটা বাইকে সালমান আর আমি এফডিসি থেকে কাঁচপুর গেছি। আবার ফিরে আসি। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

স্বামী, ছেলে ফারদিন আর মেয়ে ফাইজার সঙ্গে মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো

সালমানের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল?
আমরা তখন খুলনায় থাকতাম। ছোটবেলায় ইমন (সালমান শাহ ডাকনাম) আর আমি প্লে গ্রুপ ও নার্সারিতে একসঙ্গে পড়েছি। বাবার চাকরির কারণে ইমনের পরিবার খুলনা সার্কিট হাউসে থাকত। ওই স্কুলে আমার ফুফু ছিলেন টিচার। ফুফুর ছুটি হওয়া পর্যন্ত ইমনদের বাসায় আড্ডা দিতাম। সেও আমাদের বাসায় যাওয়া-আসা করত। ভালো বন্ধুত্ব হয়। এরপর হঠাৎ ওরা ঢাকায় চলে আসে।

ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয়। ব্যাপারটি কেমন ছিল?
বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তা ছবিটি করতে গিয়ে নতুন করে টের পাই। ছবির কাজ করার সময় আমাদের দেখা হয়। আবেগাপ্লুত হলাম। অল্প কদিনেই আমাদের সম্পর্ক আবার আগের রূপ নেয়। নিজেদের সবকিছুই একজন আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে তো পরিচালক সোহান ভাই একপর্যায়ে ভুল বুঝতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন, আমরা একজোট হয়ে গেছি।

আপনাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল?
আমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। তবে সালমান আর আমার সম্পর্ক গভীর ছিল। অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আমরা শেয়ার করতাম, যা কাউকে বলতে পারতাম না। আমার জ্বর হলে ওর ভালো লাগত না, ওর কোনো অসুখ হলে আমার না। আমাদের আত্মার একটা টান ছিল। দেখা গেল, জ্বরের কারণে আমি শুটিংয়ে যেতে পারিনি, পরিচালকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেখা করতে চলে আসত। ওর কোনো ভালো হলে আমার ভালো লাগত, ওর খারাপ হলে আমার খারাপ লাগত। এমনই ছিল আমাদের অনুভূতি।

এটা তো দেখছি আরেক গল্প।
একদমই তাই। ইমনরা ঢাকায় থাকে। আমরাও তো ঢাকায় চলে আসছি, দেখা হয় না কেন? ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে অভিনয়েরও এক বছর আগের কথা। আমরা তখন মোহাম্মদপুরে একটা কোচিংয়ে পড়তাম। ওখানে ওকে প্রায়ই দেখতাম। ও আবার আমার এক বন্ধুর বন্ধু ছিল।

মেয়ে ফাইজার সঙ্গে মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো

ছবির বিষয়ে দুজনের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল?
ধানমন্ডির ম্যাকডোনাল্ড চায়নিজ রেস্তোরাঁয় সোহান ভাইসহ অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে দেখি ই-হক কোচিংয়ের ওই ছেলেটা। ও আমাকে দেখলে কী ভাববে, ভেবে আমি মুখ লুকাই। দেখলাম, ও আর সামনে এগোচ্ছে না। ও ভাবছে, আমি ওকে সন্দেহ করছি। আর আমি ভাবলাম, ও কারও সঙ্গে ডেট করতে আসছে। সোহান ভাইয়ের তো মাথায় টাক। একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে আমি কেন এখানে—এ প্রশ্ন সে মনে মনে ভাবতেই পারে। একটু পর সোহান ভাইকে বললাম, আপনার হিরো কই। এই ছেলেটা আপনার হিরো নাকি? ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এই ইমন (হাসি)। কী সিকোয়েন্স! বাস্তব জীবনেই একটা চলচ্চিত্র।

ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারটি কেমন ছিল?
একটি পুরোনো সম্পর্ক সামনে চলে আসে। ইমন বলল, তুমি আরিফা (মৌসুমীর নাম), তোমাকে কত খুঁজছি। আমিও বললাম, আরে তোমাকে আমিও কত খুঁজছি। আমাদের দেখা হলো। অল্প কদিনেই আমাদের সম্পর্ক আবার আগের রূপ নেয়। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কত ঘটনা ঘটেছে।

কী সেই ঘটনা?
ছবির শুটিংয়ে সময় রাতে কোনো প্রয়োজনে সোহান ভাই আমার বাসায় ফোন করলেও দেখতেন ব্যস্ত, ইমনের বাসার ফোনও ব্যস্ত। তাঁর সন্দেহ হলো। আবার যখন জানতে পারলেন, আমরা বন্ধু, তখন তিনি আরও সিরিয়াস হয়ে যান। আমাদের কথা আড়ি পেতে শুনতেন। বিষয়টি টের পেয়ে ইমনের মেজাজ খুব খারাপ হয়।

সালমান শাহ মেজাজি ছিলেন?
মেজাজ ছিল ঠিকই, তবে মনটা খুব ভালো ছিল। সে খুব খোলা মনের মানুষ ছিল। একদম সানীর (মৌসুমীর স্বামী চিত্রনায়ক ওমর সানী) মতোই। আমার ভাগ্যে এমন মানুষই থাকে।

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির কোন গানটা এখনো গুন গুন করে গেয়ে ওঠেন।
‘এখন তো সময়, ভালোবাসার’ গানটা আনমনে প্রায়ই গেয়ে উঠি। অন্য গানগুলোও ভালো লাগে। প্রতিটি গানের সুর আকর্ষণীয় মনে হয়। এমনিতে গানের সঙ্গে কমবেশি যুক্ত ছিলাম। যেকোনো আড্ডার মধ্যে গান থাকত।

ভক্তদের সঙ্গে মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো

ছবিটি এতটা সাড়া ফেলবে, ভেবেছিলেন?
এটা যে প্রেমের আদর্শ গল্প হয়ে যাবে, এই জুটি যে প্রেমের আদর্শ জুটি হবে, প্রিয় জুটি হয়ে উঠবে ভাবিনি। মানুষ এত বড় স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে না। যখন পেছনে ফিরে তাকাই দেখা যায়, এই স্বপ্নটা যদি দেখতাম, তাহলে স্বপ্ন দেখেই মারা যেতাম। ২৫ বছর সমানতালে জনপ্রিয় থাকবে একটা ছবি, আমাকে ‘কেয়ামত–কন্যা’ ডাকবে! এখনো সালমান মানে আমি, আমি মানে সালমান যে ভাববে, অথবা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির প্রতিটি গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্পর্শ করবে—এসব ভাবার মতো শক্তি আল্লাহ দেননি। এটা আল্লাহর দান। এটা মানুষ কখনো সৃষ্টি করতে পারে না।

২৫ বছর কেটে গেল। এই দীর্ঘ সময়ে কতটি ছবি করেছেন?
দুই শতাধিক ছবিতে তো কাজ করেছি।

কোন ছবিকে আলাদা করে রাখবেন?
এখানে অনেক ব্যাপার কাজ করে। ভালো ছবি মানেই যে আর্ট ফিল্ম ঘরানার হতে হবে, তা নয়। কিছু ছবি আমাকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে, মানুষের মনের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। দেখা গেছে, এসব ছবি আমি কখনোই করতে চাইনি, কিন্তু দর্শকপ্রিয়তা ঠিকই পেয়েছে। তার মধ্যে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘লুটতরাজ’—এগুলো মাইলফলক। আমি হয়তো যেটা খুব পছন্দ নিয়ে করেছি, কিছু মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কিছু হিট আছে, সুপারহিট আছে, কিছু ফ্লপ হয়েছে—এসব অনেক ছবিই হয়তো আমার ভালো লেগেছে।

এই দীর্ঘ অভিনয়জীবনে কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে?
আমি আসলে আকাঙ্ক্ষা কী থাকল, তা নিয়ে ভাবি না। এটা নিয়ে ভাবলে আফসোস বেশি হয়। যেটা পারিনি, সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। যা পেয়েছি, সেটা তো অনেকেই পায়নি।

পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে কেক খাইয়ে দেন মৌসুমী। ছবি: প্রথম আলো

সালমানের পর আরও অনেকের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কাকে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন?
একজনকে মনে হয়েছে, যাকে শেষ পর্যন্ত আমার জীবনসঙ্গী করেছি। একজন পুরুষ হিসেবে আজ পর্যন্ত তাঁর মধ্যে কোনো ঝামেলা পাইনি। আমার বন্ধু, সহকর্মী আর জুনিয়রদের মধ্যে অনেকে যারা এখনো বিয়ে করেনি, তারা যখন বলে, সানী ভাইয়ের মতো ছেলে পেলে বিয়ে করে ফেলব। এটা শুনলে আমার কান্না চলে আসে।

স্বামী ও চিত্রনায়ক ওমর সানী ছাড়া কে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য?
আমার স্বামী ছাড়া যদি একজনের কথা বলি, তিনি মান্না ভাই। শুধু সহশিল্পী নন, একজন ভালো পরামর্শক ছিলেন।

আপনার সহকর্মীদের অনেকের সংসার ভেঙে গেছে, সেখানে এখনো বাস্তব জীবনের আদর্শ জুটি হয়ে আছেন। সংসার টিকিয়ে রাখার মন্ত্র কী?
মন্ত্রটন্ত্র কিছু নয়। সংসারের সুখ আসলে স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের মধ্যে হয়। কেউ যদি হ্যাপি হতে চান, স্যাক্রিফাইস করে যান। আপনার স্যাক্রিফাইস দেখতে দেখতে একসময় আপনার সঙ্গীও স্যাক্রিফাইস করতে বাধ্য হবেন। এ ছাড়া দুজনের মধ্যে সম্মান থাকতে হবে।

জীবনে অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অনেক সংবাদকর্মীর মুখোমুখি হয়েছেন। সামনে কখনো সাংবাদিকতা করার ইচ্ছে আছে?
পত্রিকা নিয়ে বরাবরই আমার একটা আগ্রহ আছে। অনলাইনে এখন বেশি আগ্রহী। ভেবেছি, আমার পরবর্তী ক্যারিয়ার কী হতে পারে, খুব ভালোবাসার একটা জায়গা জুড়ে আছে সাংবাদিকতা। রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ পাই না। ভেবেছি সাংবাদিকতা নিয়ে কিছু করব।