Thank you for trying Sticky AMP!!

ওহো, রুক্সী আপনি তো টিচার!

নব্বইয়ের দশকের আলোচিত কণ্ঠশিল্পী রুক্সী আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

গানকে কখনোই পেশা হিসেবে নেননি নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুক্সী আহমেদ। কিন্তু গান করেছেন শতভাগ পেশাদারির সঙ্গে। তবে শিক্ষকতাই তাঁর সব সময়ের পেশা। আগামী বছর শিক্ষকতায় ২৫ বছর পূর্ণ হবে তাঁর। 

১৯৯৫ সালে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে যোগ দেন রুক্সী। এখন তিনি এ কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তাঁর বিভাগে দুই থেকে আড়াই হাজার ছাত্রী। কলেজের কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকেন। গানের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। এ কথা শ্রোতারাও নাকি জানেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে শ্রোতারা ‘কেন আপনাকে গানে পাওয়া যায় না’ এ প্রশ্ন করার পর নিজেরাই উত্তর দেন, ‘ওহ, রুক্সী আপনি তো টিচার!’


রুক্সী জানালেন, তিনি শুরু থেকেই শিক্ষকতার পাশাপাশি গান গেয়েছেন। ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘সেই চেনা মুখ’ প্রকাশিত হয়। তারপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে কলেজে ঢোকেন। চাকরিতে ঢোকার বছরই তাঁর দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘মনচোরা’ প্রকাশ হয়। কখনোই গান ও পেশা এ দুটোর সংঘর্ষ হয়নি। এখন গান থেকে কিছুটা দূরে থাকার কারণ শুধুই চাকরি নয়। ক্যাসেট থেকে সিডি হলো। সিডি থেকে এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। গানের জগতে যে অবিরাম পরিবর্তন, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোন মাধ্যমে কীভাবে গান করা যায়, তা নিয়ে ভাবতেই সময় বয়ে গেছে তাঁর।


রুক্সীর মা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। চাকরি করেও মাকে সময় দিতে হয়েছে তাঁর। তারপর ২০১৪ সালে মা মারা গেলেন। একটা সময় রুক্সীকে গানের জগতে দৌড়ঝাঁপের ব্যাপারে মা সাহায্য করতেন। এটা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাসেটের যুগে পাটুয়াটুলীতে সব অডিও কোম্পানি ছিল। এটা ছিল রুক্সীর জন্য সুবিধার। সব কোম্পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ায় এগুলোর সঙ্গে যোগাযোগও আগের মতো মসৃণ নেই তাঁর। তার পরও তিনি গান ছাড়েননি। এখনো নিয়মিত স্টেজ শো করেন। শেষ কনসার্ট করেছেন জাপানে। করোনার কারণে বাতিল হয়েছে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়ার কনসার্টগুলো।


বছরখানেক আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ‘লাইভ’ গানের অনুষ্ঠানে গেয়েছেন রুক্সী। তারপর আর চ্যানেলে গাওয়া হয়নি। মিউজিশিয়ান ভালো না হলে, আয়োজন ঠিকঠাক না থাকলে ‘লাইভে’ গাইতে চান না তিনি। এসব অনুষ্ঠানে অন্য শিল্পীদের গান গাওয়ার চাপ থাকে। অথচ তাঁর নিজের গাওয়া মৌলিক গানের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০। রুক্সী বললেন, ‘আমাদের নব্বইয়ের দশকের শিল্পীদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উচিত আমাদের গানগুলো গাওয়ার সুযোগ দেওয়া। আমি রুক্সী আমার নিজের দশটা গান গাইব, এটাই স্বাভাবিক। আমরা যারা এত কষ্ট করে মৌলিক গান গেয়ে এ জায়গায় এসেছি, তাদের অন্য শিল্পীর গান গাইতে বললে দুঃখ লাগে। এ জন্য আমি অনেক সময় লাইভ প্রোগ্রামে যাই না। আর গেলেও আগে জিজ্ঞেস করে নিই, তোমারা কি আমাকে নিজের গান গাওয়ার সুযোগ দেবে?’


রুক্সী একই প্রসঙ্গে আরও বললেন, ‘যারা জীবিত আছে, সুস্থ আছে, যারা এখনো ভালো গান গাইতে পারে, তাদের গান কেন আমি গাইব? তাদের ডাকলেই পারে। সিনিয়রদের গান আমাদের গাইতে বলে শিল্পীদের অপমান করছে, আমাদেরও অপমান করছে। যাদের নতুন গান নেই, তাদের দিয়ে হারানো দিনের গান গাওয়াতে পারে, কাভার সং গাওয়াতে পারে। যেসব শিল্পী আর বেঁচে নেই, তাদের সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের রয়েছে। সেই শিল্পীদের গান গাইতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যে শিল্পীরা এখনো ভালো গাইতে পারে, সেসব সিনিয়র শিল্পীর গান নতুনেরা কেন গাইবে?’


রুক্সী উদাহরণ টানলেন সেই সময়ের বিটিভির। সেখানে একটা অনুষ্ঠানে পুরোনো দিনের গান গাইতেন নতুন শিল্পীরা। আরেকটা অনুষ্ঠানে শিল্পীরা যে যাঁর নিজের গান গাইতেন। রেডিওতে সব সময় নিজের গানই করেন বলে জানালেন রুক্সী। ১০০ গানের একটা খাতা বানিয়ে রেখেছেন। রেডিওতে ধরে ধরে সেসব গানই করেন। অডিও মাধ্যম বলে সেখানে সুরের প্রতি লক্ষ রাখতে হয়, গায়কির প্রতি লক্ষ রাখতে হয়। এটা তাঁর খুবই ভালো লাগে। টিভিতে লাইভ গেয়ে রেডিওর মতো আনন্দ পান না তিনি।

কণ্ঠশিল্পী রুক্সী আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

রুক্সীর প্রশ্ন, সব গানের অনুষ্ঠানই ‘লাইভ’ হতে হবে কেন? ‘আগে আমরা লিপসিং করতাম। দর্শকেরা মজা পেত। লাইভ প্রোগ্রামে হাতে গোনা কিছু ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা যায়। আপনি কি লাইভে সন্তুর ব্যবহার করতে পারছেন? অথচ আমাদের এমন গানও আছে যেখানে স্যাক্সোফোন, সরদ, কী না ব্যবহার করেছি! আগে স্টুডিওতে একদল মিউজিশিয়ানস যেত, আরেক দল আসত। ঈদের সময় মনে হতো স্টুডিওতে উৎসব চলছে। আর এখন? সুরকারেরা যে যার বাসায় স্টুডিও তৈরি করে ফেলেছে।’
রুক্সী আক্ষেপ করলেন, ‘এক লাইন করে গেয়ে রেকর্ডিংয়ের চল হয়েছে আজকাল। এভাবে কি গানের ভেতর ঢোকা যায়? আগে আমরা পুরো গান একবারে গাইতাম। সুরকাররা বলতেন, পুরো গান না গাইলে গানকে ধারণ করা যাবে না। দেবু ভট্টাচার্য, খন্দকার নুরুল আলম, শেখ সাদী খানদের কিছু গান আমিও গেয়েছি। তাঁরা বলতেন, পুরো গান না গাইলে ভেতরের ইমোশন আসবে না। গেয়ে ফেলার পর যে জায়গাগুলোতে উচ্চারণ ঠিক নেই, ওই জায়গাগুলো কারেকশন করে নেওয়া হতো। তবুও এক বসাতেই পুরো গান গাইতে হবে।’

কণ্ঠশিল্পী রুক্সী আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

রুক্সীর আক্ষেপ আছে মঞ্চে গাওয়ার ব্যাপারেও। ‘মঞ্চে মেলোডি গান গাওয়ার সুযোগই পাই না। আগেই নাচের গান গাওয়ার আবদার, “গরম গান করেন।” তবে কি ভালো গানগুলো শুনবে না কেউ?’ প্রশ্ন রুক্সীর। রুক্সী মনে করেন, গানের জগতে যে এলোমেলো অবস্থা, সবাইকে এক জায়গায় বসে এগুলো ঠিক করে নেওয়া উচিত। ‘আমরা গানের মানুষেরা একাত্ম নই। আমাদের দেশের গানগুলো কীভাবে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাবে, তার একটা নির্দেশনা থাকা উচিত। আমাদের সংগীত জগতের কোনো সম্মিলিত সংগঠন নেই। আমরা সংগঠিত হলে গানটাকে এগিয়ে নিতে পারতাম।’
প্রায় ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে ৭/৮টা একক অ্যালবামে গেয়েছেন রুক্সী। ১৪/১৫টা মিশ্র অ্যালবামে গেয়েছেন। প্রায় ১০০ সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। জিঙ্গেলও করেছেন শ খানেক। অসংখ্য গান গেয়েছেন টিভিতে ও বেতারে। প্রায় ২০টি দেশে স্টেজ শো করেছেন। তাঁর মৌলিক গানের সংখ্যা ৫০০-র কাছাকাছি। যার মধ্যে জনপ্রিয় কিছু গান ছাড়া অনেক গানই কম প্রচারিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এসব গানের মধ্য থেকে শ খানেক গান বাছাই করে নতুনভাবে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে তাঁর। নতুন মাধ্যমে পুরোনো রেকর্ড করা গানগুলো শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি। গান নিয়ে এটাই আপাতত পরিকল্পনা নব্বইয়ের দশকের আলোচিত কণ্ঠশিল্পী রুক্সী আহমেদের।