Thank you for trying Sticky AMP!!

ওয়ারফেজের পথচলা পঁয়ত্রিশ ছুঁয়েছে

চৌত্রিশ বছর পেরিয়ে এসে এখন ওয়ারফেজে আছেন এই সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

আশির দশকের মাঝামাঝি। বিশ্বের সংগীতাঙ্গন তখন কাঁপছে মেটাল জ্বরে। পশ্চিমা বিশ্বে একের পর এক গড়ে উঠছে মেটাল ও হার্ড রক ব্যান্ড। চারদিকে কনসার্টের জোয়ার। মেটালিকা, আয়রন মেইডেন, জুডাস প্রিস্ট, ব্ল্যাক স্যাবাথ, ডিপ পার্পল, স্করপিয়ন, রেইনবোর মতো ব্যান্ডগুলোর গান যেন পৃথিবী শাসন করতে শুরু করল। মেটাল হার্ড রকের উন্মাদনা স্পর্শ করল ঢাকাকেও। একের পর এক তারুণ্যনির্ভর হার্ড রক ব্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে যাদের কথা প্রথমেই উচ্চারিত হয়, সেটি হচ্ছে ওয়ারফেজ। ৬ জুন ওয়ারফেজ ৩৫ বছরে পা রাখল।

শুধু সুর সংগীতে ব্যতিক্রম নয়, ৩৪ বছরের দীর্ঘ পথচলায় এমন কোনো বিষয় নেই, যা তাদের গানে উঠে আসেনি। প্রেম, প্রতিবাদ, অনিয়ম, সংগ্রাম, মনস্তাত্ত্বিক চাওয়া-পাওয়া, প্রজন্ম সবকিছুর কথাই উঠে এসেছে তাদের গানের কথায়। ‘শক্ত কথা’কে শক্ত সুরে অসাধারণ দক্ষতায় পরিবেশন করেছে তারা, যা ছুঁয়ে গেছে তরুণ শ্রোতার হৃদয়।

‘মহারাজ’, ‘অসামাজিক’, ‘ধূসর মানচিত্র’ যেমন শ্রোতাকে আন্দোলিত করেছে, তেমনি ‘অবাক ভালোবাসা’, ‘পূর্ণতা’র মতো গানগুলো শ্রোতার প্রেমকে জাগিয়েছে নতুন করে। কনসার্টে তরুণ শ্রোতাদের ওয়ারফেজের গান কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে ওয়ারফেজকে। দেখা গেছে মাদকবিরোধী প্রচারণাও। অনেকের মতে বাংলাদেশে হার্ড রক ব্যান্ডের ভুবনে ওয়ারফেজ একটা বটগাছের মতো, যার প্রেরণা, ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য হার্ড রক ব্যান্ড। দেশে তো বটেই, কলকাতায়ও অনেক ব্যান্ডের শুরুই হয় ওয়ারফেজের গান চর্চা করে।

প্রতিষ্ঠাতা অন্য সদস্যরা হলেন কমল, হেলাল, মীর, নাইমুল, বাপ্পি। পরে কমল ছাড়া অন্য কেউ দলের সঙ্গে ছিলেন না। একাধিকবার বিরতি নিয়ে কমল এখন দলের সঙ্গে আছেন। কমলের স্মৃতিচারণায় জানা গেল ওয়ারফেজের শুরুর কথা। বললেন, ‘তখন সবাই স্কুলে পড়ছি। সেন্ট যোসেফ স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমরা। গিটার কেনা হলো। গিটার কেনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি ব্যান্ড গঠন করি। ১৯৮৪ সালের ৬ জুন। ৮৯ লেকসার্কাস কলাবাগান ঠিকানায় যাত্রা শুরু করে ওয়ারফেজ। তখন আমরা সবাই শিখছিলাম। আর কনসার্টে গান করি ১৯৮৮ সালে।’ ওই সময়ের আরও কয়েকটি ব্যান্ডের কথা বললেন তিনি, ‘ওই সময় হার্ড রক ধাঁচের গান করত ওয়ারফেজ, রক স্টার্টা, ইন ঢাকা আর অ্যাসেস। আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।’

১৯৯৬ সালের কমল, সাঞ্জয়, বাবনা, রাসেল ও ফুয়াদ ইবনে রাব্বী

তিন দশকের বেশি সময়ের পথচলায় বারবার ভাঙাগড়ার মধ্যে এগিয়ে যায় ওয়ারফেজ। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন, তিনি টিপু। শেখ মুনিরুল আলম টিপু বর্তমানে বামবার সাধারণ সম্পাদক। শুরুর দিকেই দলে যোগ দেন তিনি। ওয়ারফেজের সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোতে একজন আদর্শ দলনেতার মতো হাল ধরে রেখেছিলেন ব্যান্ডের। একের পর এক লাইন-আপে পরিবর্তন এলেও তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমরা কিন্তু বিভিন্ন দেশের হার্ড রক আর হেভি মেটাল ব্যান্ডের জনপ্রিয় গান করেছি মঞ্চে। এরপর ওয়ারফেজ অ্যালবামটি বাজারে আসার পর একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, সবাই তখন আমাদের গান শুনতে চায়। আমরাও নতুন নতুন গান তৈরি করতে থাকি। এখন আমরা নিজেদের গানই করছি।’

শুরুতেই সাড়া ফেলেছিল ওয়ারফেজ
প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ১৯৯১ সালর ২১ জুন ওয়ারফেজ নামের অ্যালবাম দিয়ে অডিও বাজারে যাত্রা শুরু করে তারা। যেখানে সব গানই হার্ড রক আর হেভি মেটাল। ‘একটি ছেলে’, ‘বসে আছি’, ‘বিচ্ছিন্ন আবেগ’, ‘স্বাধিকার’, ‘কৈশোর’,‘বৃষ্টি নেমেছে’ গানগুলো রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে। একটু অন্য রকম বাংলা গানের স্বাদ পেলেন শ্রোতারা। কিছু শ্রোতা তো শুরুতেই তা লুফে নিলেন, অল্পদিনে এই গান এক কান থেকে অন্য কানে পৌঁছে যায়। নতুন কথা, নতুন সুর। সব মিলে দারুণ সাড়া ফেলে চারদিকে। একটি নতুন ব্যান্ডের নাম জানতে পারে সবাই।

প্রথম অ্যালবামটা শ্রোতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার পর ওয়ারফেজের সদস্যরা সাহসী হয়ে ওঠেন। এ সময় নতুন অ্যালবামের কাজ হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে কমল ও রাসেল দেশ ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। অবশ্য ব্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়নি তাঁদের। একসময় ব্যান্ডের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে ছুটিতে দেশে আসেন তাঁরা। শুরু হয় দ্বিতীয় অ্যালবামের কাজ। নাম দেওয়া হয় ‘অবাক ভালোবাসা’। অ্যালবামটি দেশের হেভি মেটাল ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল অ্যালবাম।

অ্যালবাম রিলিজের পরপরই রাসেল ব্যান্ড ত্যাগ করলে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে ব্যান্ডে যোগদান করেন ফুয়াদ ইবনে রাব্বি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের আরেক সফল অ্যালবাম বের করে তারা। ‘জীবনধারা’ বাজারে আসে। এবার একটু নতুন অ্যালবামটি মূলত মেলোডি-নির্ভর ছিল। তবে ‘জীবনধারা’ এই অ্যালবামের শিরোনাম গানটিসহ ‘দিন বদলের পালা’, ‘হেঁয়ালি’, ‘নিঃশব্দে’ হেভিমেটাল গান ছিল। সেবার মূলত গান নিয়ে পরীক্ষা করেছিল ওয়ারফেজ। হার্ড রকের সঙ্গে মেলোডির মিশ্রণ। শ্রোতারা পেয়েছিলেন ‘জননী’, ‘মৌনতা’, ‘ধুপছায়া’, ‘জীবনধারা’সহ বেশ কিছু অসাধারণ গান। তবে এই অ্যালবাম বাজারে আসার পরপরই বাবনা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এই বছর ‘ধুন’ নামে একটি মিশ্র অ্যালবামে ওয়ারফেজের ‘মুক্তি চাই’ এবং ‘মনে পড়ে’ গান দুটি জনপ্রিয়তা পায়।

ওয়ারফেজের প্রথম অ্যালবাম থেকেই ছিলেন কমল ও টিপু

এ সময় বেজবাবা সুমন ওয়ারফেজে যোগ দেন বাবনার জায়গায়। নতুন গিটারিস্ট এবং ভোকাল হিসেবে যোগ দেন আসিফ ইকবাল জুয়েল। এই দল নিয়ে ‘অসামাজিক’ অ্যালবামটি ১৯৯৮ সালে শ্রোতাদের হাতে পৌঁছে। ‘অসামাজিক’, ‘ধূসর মানচিত্র’, ‘নেই প্রয়োজন’, ‘বন্ধু’, ‘মহানগর’, ‘অশনিসংকেত’, ‘এমন দিনে’, ‘প্রতিচ্ছবি’সহ সব গানই আলোড়ন তোলে রক গানে শ্রোতাদের কাছে। এটিও ছিল মেলোডিনির্ভর আর রক গানের এক অসাধারণ যুগলবন্দী।

সাঞ্জয় চলে গেল ...
‘জীবনধারা’, ‘অবাক ভালোবাসা’, ‘অসামাজিক’ অ্যালবামগুলোর গানে এবং মঞ্চের পরিবেশনায় তখন তুমুল জনপ্রিয় ওয়ারফেজ। এত বড় সাফল্যের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কার মুখোমুখি হতে হয় ওয়ারফেজকে। সাঞ্জয় ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ত্যাগ করেন। ওই সময়ে তরুণ শ্রোতাদের কাছে সাঞ্জয়ের তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। তার মতো হাই-পিচ গান গাওয়া ব্যান্ডের শিল্পী তখন ছিল না বললেই চলে। এরপরই সুমন, জুয়েল ব্যান্ড ছেড়ে গেলে দুই বছর বলতে গেলে স্থবির হয়ে ছিল ওয়ারফেজ। থাকেন শুধু কমল ও টিপু। ১৯৯৯ সালে তাঁদের সঙ্গে মিজান, বালাম, শামস ও বিজু দলে যোগ দিলেন। ২০০০ সালে তাঁদের পঞ্চম স্টুডিও অ্যালবাম ‘আলো’ বাজারে আসে। ‘বেওয়ারিশ’, ‘হতাশা’, ‘বৃষ্টি’, ‘সেই স্মৃতিগুলো’ গান দিয়ে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেন মিজান। সড়ক দুর্ঘটনায় কমলের নিহত ভাইয়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয় অ্যালবামটি। আবারও দল ভাঙে। পারিবারিক কারণে দ্বিতীয়বারের মতো কমল ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন। কানাডাপ্রবাসী হয়ে যান বিজু। ব্যান্ড ত্যাগ করেন মিজানও। কিছুদিনের মধ্যেই সাজ্জাদ, আর্টসেলের সেজান বেজিস্ট হিসেবে ওয়ারফেজের সঙ্গে যুক্ত হন।

২০০৩ সালে ওয়ারফেজের ষষ্ঠ স্টুডিও অ্যালবামটিও বাজারে আসে। আগের অ্যালবামগুলোর মতো ততটা আলোড়ন তুলতে না পারলেও ‘মহারাজ’, ‘হারিয়ে তোমাকে’, ‘সাইক্লোন’, ‘হেরেছ’, ‘স্বপ্ন তুমি নও’ গানগুলো শ্রোতারা পছন্দ করেন। এবার সেজান পড়াশোনার কারণে ওয়ারফেজ ত্যাগ করলে মেটাল মেইজের সেই সময়ের বেজিস্ট রজার যোগ দেন ওয়ারফেজে। কিন্তু ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান বালাম তাঁর ব্যক্তিগত অ্যালবামের কাজ করার জন্য। এ সময়ে এসে মিজান আবারও ওয়ারফেজে ফিরে আসেন। তাঁরা ২০০৯ সালে তাঁদের পুরোনো গানগুলোকে ‘পথচলা’ অ্যালবামের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করেন শ্রোতাদের জন্য। ‘তোমাকে’ ও ‘অমানুষ’ এই দুটি ছিল অ্যালবামের নতুন গান।

আন্তর্জাতিক পরিসরে ওয়ারফেজের নামডাক
দ্য টপটেন্স ডটকম জরিপভিত্তিক ওয়েবসাইট। এখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন বিষয়ে ‘টপ টেন’ বা সেরা দশ নির্বাচন করে। সে কারণে ‘টপ টেন হার্ড রক ব্যান্ডস’-এর এই তালিকা নিয়মিত আপডেট হচ্ছে। ২০১৭ সালে ‘টপ টেন’-এর জরিপে হার্ড রক ক্যাটাগরিতে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ডগুলোর মধ্যে বর্তমানে ৪ নম্বরে অবস্থান করেছিল ওয়ারফেজ। শুধু তা-ই নয়, তিন বছর ধরে এ তালিকার সেরা দশে অবস্থান ছিল দলটির। কাছাকাছি ছিল আরও দুটি বাংলাদেশি ব্যান্ড, ১৯ নম্বরে ছিল অর্থহীন, আর ২৮ নম্বরে অবস্থানে ছিল আর্টসেল।

কনসার্টে গান করছেন ওয়ারফেজের সদস্যরা

দেশ-বিদেশে সাফল্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যান্ডের লিডার ও ড্রামার শেখ মনিরুল আলম টিপু বলেন, ‘১৯৯১ সালে যখন প্রথম অ্যালবাম রিলিজ করি, তা কিন্তু আমাদের প্রচলিত সংগীত ভুবনে এটি ছিল নতুন একটা আওয়াজ। আর তখনই যে সফল হব, তাও চিন্তা করিনি। ভালো ও ভিন্ন কিছু করব, সে তাগিদেই করেছি। অবশ্য ভেতরে-ভেতরে বিশ্বাস করতাম, এর ফল পাব ১৫-২০ বছর পর। এরপর আস্তে আস্তে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে পুরো দেশের নতুন প্রজন্মের ভেতর রক গান ছড়িয়ে পড়ল। যে বীজটা রোপণ করেছিলাম, তার ফলটা কিন্তু ২০-২৫ বছর পর হলেও এসেছে এবং সে পথ ধরে বাংলা রক গানে এখন নতুন নতুন অনেক ব্যান্ড সৃষ্টি হয়েছে। আসলে আমরা এত বছর ভালো মিউজিক করে ব্যান্ডটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে বড় কথা, মৌলিক গান নিয়েই আমরা এগিয়েছি। সম্ভবত এসবেরই মিলিত ফল আমাদের আজকের এ অর্জন।’

নতুন অ্যালবাম নিয়ে ব্যস্ত ওয়ারফেজ
তাদের সর্বশেষ স্টুডিও অ্যালবাম ‘সত্য’ ২০১২ সালে বাজারে আসে। ‘রূপকথা’, ‘পূর্ণতা’, আগামী, ‘প্রজন্ম’সহ সব কটি গানই আলোচনায় আসে। এর আগে ‘সমর্পণ’ মিশ্র অ্যালবামে ‘লালন’-এর গানগুলো ছুঁয়ে গেছে প্রতিটি শ্রোতার হৃদয়। পথচলার ৩৪ বছরে দুবার দুটি বহুজাতিক কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছিল ওয়ারফেজ।

ওয়ারফেজ ব্যান্ডের বর্তমানে আছেন টিপু, কমল, শামস, পলাশ, সামিন, রজার ও সৌমেন। দলনেতা টিপু জানান, এখন তাঁরা ব্যস্ত নতুন অ্যালবামের কাজ নিয়ে। শিগগিরই অষ্টম অ্যালবাম নিয়ে বাজারে আসছেন তাঁরা। এটি হবে পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। শুভ কামনা রইল ওয়ারফেজের জন্য।